শান্তিপুর–নবদ্বীপ ঘাট লাইট রেল পরিষেবা
১৮৯৯ সালে মার্টিন লাইট রেলওয়ে কোম্পানি ২ ফুট ৬ ইঞ্চি (৭৬২ মিমি) ন্যারো গেজ লাইনে এই পরিষেবা চালু করে।শুরুতে, দিনে ৫ জোড়া ট্রেন চলত, আর শেষের দিকে মাত্র ৩ জোড়া ট্রেন চলছিল। আমি কোনও সিগন্যালিং সিস্টেম লক্ষ্য করিনি, শুনেছি যে টোকেন কেবল শান্তিপুরে দেওয়া হয়।
লাইনটি দুটি ভাগে বিভক্ত ছিলঃ
১. শান্তিপুর জংশন-কৃষ্ণনগর সিটি জংশন লাইট রেল সেকশনঃ প্রায় ১৮ কিলোমিটার বা ১২ মাইল দীর্ঘ এই অংশটি ১৯০৪ সালে ইস্টার্ন বেঙ্গল রেলওয়ে অধিগ্রহণ করে এবং এর নামকরণ হয় রানাঘাট-কৃষ্ণনগর ব্রাঞ্চ।
২. কৃষ্ণনগর সিটি জংশন-নবদ্বীপ ঘাট লাইট রেল সেকশনঃ ২৭ কিলোমিটার বা ১৭ মাইল দীর্ঘ এই অংশটি অদ্ভুতভাবে ১৯০৮ বা ১৯১৮ সালের কোনো সরকারি রিপোর্টে উল্লিখিত ছিল না। তবে, ১৯৪৭ সালের ভারতীয় রেলের অ্যাডমিনিস্ট্রেশন রিপোর্টে এটি "In Operation Narrow Gauge Line" হিসেবে দেখানো হয়।
এই দুই সেকশন মিলেই তৈরি হয়েছিল শান্তিপুর জংশন-নবদ্বীপ ঘাট লাইট রেল (ভায়া কৃষ্ণনগর সিটি জংশন)। শেষের কয়েকদিন ধরে, যাত্রীর অভাবে কৃষ্ণনগর থেকে নবদ্বীপ ঘাট পর্যন্ত আমঘাটা এবং মহেশগঞ্জ স্টেশন বন্ধ করে দেওয়া হয়।পূর্ব রেলের অধীনে এই রুটটি ২০১৪ সাল পর্যন্ত চালু ছিল।বর্তমানে এটি ব্রড গেজে রূপান্তরিত হয়েছে এবং পুরোটাই বিদ্যুতায়িত।
শান্তিপুর-নবদ্বীপ ঘাট রুট ও টার্ন টেবিলের গল্প
![]() |
শান্তিপুর টার্ন টেবিল |
প্রথমে এই ট্রেন বাষ্প ইঞ্জিনে, পরে ডিজেল ইঞ্জিনে চলত। নবদ্বীপ ঘাটে পৌঁছানোর পর ইঞ্জিনটি আলাদা করে টার্নটেবিলে ঘুরিয়ে আবার কামরার সঙ্গে জোড়া হত। শেষের দিকে টার্নটেবিলে ইঞ্জিন ঘোরানোর জন্য কোনো কর্মী নিযুক্ত ছিল না। চালকের সঙ্গে স্থানীয় ছেলেরা উৎসাহ নিয়ে নিজেরাই ইঞ্জিন ঠেলে ঘুরিয়ে দিত।
প্রথমদিকে, ট্রেনটির কামরার রঙ ছিল কমলা-সাদা ক্রিম-কমলা।যা পরে কাঁচড়াপাড়া ওয়ার্কশপের কারণে ঘন সবুজ ও সাদা ক্রিমে পরিবর্তিত হয়।
ট্রেনটি দিনে সর্বোচ্চ ৩টি ট্রিপ দিত। ১/২এনএস, ৩/৪এনএস এবং ৫/৬এনএস নম্বর নিয়ে চলা এই ট্রেনের যাত্রাপথের ভাড়া ছিল মাত্র ৫ টাকা।বাষ্প ইঞ্জিন থেকে ডিজেল রেলবাসে রূপান্তর:
১৯৬০-এর দশকের শেষের দিকে বাষ্পীয় ইঞ্জিনের যুগ শেষ হলে, শান্তিপুর-নবদ্বীপ ঘাট রুটে অশোক লেল্যান্ড নির্মিত ডিজেল রেলবাস চালু হয়। এই সবুজ-হলুদ রঙের রেল-বাস গুলোতে একটি মোটর কোচ (EZZS) এবং দুটি ট্রেলার কোচ থাকত। এটি ১৯৭০-এর দশকে এই রুটে আগমন করে এবং বাসের মতো দেখতে হওয়ায় এর যাত্রী ধারণ ক্ষমতাও বেশি ছিল। সাধারণত তিনটি কামরা থাকলেও রাস উৎসবের মতো বিশেষ অনুষ্ঠানে যাত্রীর চাপ বেড়ে গেলে কামরার সংখ্যা বাড়িয়ে চারটি করা হতো এবং বিশেষ ট্রেনের ব্যবস্থাও থাকত। এই সময়ে ভাড়া কিছুটা বাড়িয়ে দেওয়া হতো, যার উল্লেখ স্বরুপগঞ্জের পরিত্যক্ত নবদ্বীপ ঘাট স্টেশনে এখনও পাওয়া যায়।
১৯৭৮ সালের ভয়াবহ বন্যায় এই রেলপথটি ব্যাপকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়, যার ফলে গতি কমে ১৫ কিমি/ঘণ্টা হয়ে যায়। ধীরে ধীরে এই লাভজনক রুটটি চরম লোকসানের শিকার হয়। এর প্রধান কারণ ছিল টিকিট কাটার অনীহা।
ধীর গতির কারণে যাত্রীরা প্রায়শই বাড়ির সামনে থেকে ট্রেনে ওঠানামা করতেন এবং স্টেশনগুলো কেবল নামেই ছিল। কাউন্টারগুলো প্রায়ই বন্ধ থাকায় যাত্রীরা টিকিট কাটতে চাইলেও পারতেন না।
কৃষ্ণনগর স্টেশন এক সময় এই রুটের একটি গুরুত্বপূর্ণ জংশন ছিল। এখানে তিনটি লাইন এবং দুটি প্ল্যাটফর্ম ছিল, যেখানে ট্রেন ক্রসিং এবং বাষ্পীয় ইঞ্জিনে জল দেওয়ার ব্যবস্থা ছিল। কিন্তু সময়ের সাথে সাথে কৃষ্ণনগর স্টেশন বড় করার জন্য ন্যারো গেজের লাইন সংখ্যা কমে একটিতে দাঁড়ায়। এরপর থেকে এই রুটে 'One Train Only System' ট্রেন চলত, অর্থাৎ একটি মাত্র ট্রেন সারা দিনে তিনটি ট্রিপ দিত।
👉শান্তিপুর – নবদ্বীপ ঘাট লাইট রেলের পুরোনো সময়সূচীঃ
ট্রেন নং | ছাড়ার সময় (শান্তিপুর) |
---|---|
১৫১ আপ | সকাল ৪:০৫ |
১৫৩ আপ | সকাল ৮:৪৮ |
১৫৫ আপ | বিকেল ৩:১৫ |
👉অন্যদিকে, নবদ্বীপ ঘাট → শান্তিপুর ডাউন পুরোনো সময়সূচীঃ
ট্রেন নং | ছাড়ার সময় (নবদ্বীপ ঘাট) |
---|---|
১৫২ ডাউন | সকাল ৬:০০ |
১৫৪ ডাউন | সকাল ১১:০৫ |
১৫৬ ডাউন | বিকেল ৫:১৫ |
কৃষ্ণনগর থেকে নবদ্বীপ ঘাটের মাঝে কৃষ্ণনগর রোড, আমঘাটা, মহেশগঞ্জ এবং নদিয়া - এই চারটি স্টেশন ছিল। আমঘাটা ছাড়া বাকি স্টেশনগুলো ধীরে ধীরে অবলুপ্ত হয়ে যায়। তবে, কৃষ্ণনগর রোড স্টপেজটি, যা 'রোড স্টেশন' নামে পরিচিত ছিল, আজও মানুষের মনে বেঁচে আছে। নবদ্বীপ থেকে বাসে কৃষ্ণনগর যেতে হলে যাত্রীরা এখনও এই রোড স্টপেই নেমে যান।
গেজ রূপান্তর এবং এক নতুন অধ্যায়
অবশেষে, চরম অবহেলা ও লোকসানের শিকার এই ন্যারো গেজ লাইনটির বিদায়ঘণ্টা বাজে।তৎকালীন রেলমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় ২০১০ সালের ১৭ই জানুয়ারি গেজ রূপান্তরের ঘোষণা করেন। সেদিনই পশ্চিমবঙ্গের প্রাক্তন মুখ্যমন্ত্রী জ্যোতি বসু প্রয়াত হন।
১৮ই জানুয়ারি থেকে শুরু হয় লাইন তুলে ফেলার কাজ। শান্তিপুর জংশন থেকে কৃষ্ণনগর সিটি জংশন পর্যন্ত প্রথম পর্যায়ের কাজ শেষ হয় ২০১১ সালের মধ্যে এবং ২০১২ সালের ৭ই ফেব্রুয়ারি এটি ব্রড গেজে রূপান্তরিত হয়ে চালু হয়।
গেজ রূপান্তরের সময় একটি নতুন সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছিল যে, এই লাইনটি নবদ্বীপ ঘাটের পরিবর্তে সরাসরি নবদ্বীপ ধামে গিয়ে শেষ হবে। সেই অনুযায়ী, পুরনো স্বরূপগঞ্জের স্টেশনটি আর কোনোদিন চালু হবে না এবং নতুন একটি অ্যালাইনমেন্ট ধরে লাইনটি মহেশগঞ্জ পেরিয়ে ভাগীরথীর পাড়ে পৌঁছাবে, যেখানে নতুন নবদ্বীপ ঘাট স্টেশন তৈরি হওয়ার কথা। এরপর একটি ব্রিজ পেরিয়ে লাইনটি নবদ্বীপ ধামে পৌঁছাবে। তবে জমি সংক্রান্ত জটিলতার কারণে এই প্রকল্প থমকে আছে। আমঘাটা পর্যন্ত কাজ ৭০% সম্পন্ন হলেও, রেললাইন এবং বৈদ্যুতিক পোলগুলো আজ জঙ্গলের আড়ালে মিশে যাচ্ছে।
We welcome thoughtful discussions. Comments are moderated for quality