গোমিরা নাচের মুখোশ: ঐতিহ্য, উপাসনা এবং লোকসংস্কৃতির গল্প।

গোমিরা নাচের মুখোশ: ঐতিহ্য, উপাসনা এবং লোকসংস্কৃতির গল্প।

Raju Biswas
0

gomira-dance.jpg
Gomira Dance:The Ancient Folk Dance of Bengal

পশ্চিম বঙ্গের সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যের অন্যতম আকর্ষণ হলো মুখোশ নৃত্য। এটি শুধু বিনোদনের মাধ্যম নয়, বরং গ্রামীণ জীবনের রীতি, আচার এবং ধর্মীয় ভাবনার সাথে ওতপ্রোতভাবে জড়িত। রাজ্যের বিভিন্ন প্রান্তে নানা ধরনের মুখোশ নৃত্য প্রচলিত রয়েছে। এগুলি স্থানীয় জনগোষ্ঠীর ইতিহাস এবং বিশ্বাসের প্রতিফলন।দেখুন বিশ্বব্যাপী মুখোশ নাচের প্রচলন আছে বিভিন্ন জায়গায়। এই যেমন ধরুন প্রাচীন মিশরীয় সভ্যতা এবং ধ্রুপদী হেলেনিক এবং রোমান সভ্যতায় মুখোশ গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছে।এমনকি বর্তমানে, চীন, জাপান, ভারত এবং আফ্রিকার বিভিন্ন দেশে মুখোশ ব্যাপকভাবে ব্যবহৃত হয়। দেশজুড়ে বিভিন্ন উপজাতি এখনও মুখোশ ব্যবহার করে টোটেম হিসেবে এবং মুখোশধারী নাচগুলি আচার হিসাবে পালন করেন।

ভারতের বিভিন্ন অঞ্চলে মুখোশধারী নাচের ঐতিহ্য রয়েছে।যেমন.— 

  • উত্তরাখণ্ডের:- রামমন মুখোশ
  • লাদাখের:- বৌদ্ধ সন্ন্যাসীদের মুখোশ
  • আসামের:- মাজুলির সাতরা মুখোশ
  • আসামের:- ভাওনা মুখোশ 
  • পশ্চিমবঙ্গের:- ছৌ মুখোশ

Chhau-dance.jpg
ছৌ মুখোশ
 পশ্চিমবঙ্গের মুখোশধারী নাচের মধ্যে 'ছৌ' ছাড়াও আরো বেশ কিছু প্রাচীন নাচের ঐতিহ্য রয়েছে। মুখোশধারী নৃত্য পশ্চিমবঙ্গের বিভিন্ন অঞ্চলে প্রচলিত।এই সব নাচ ও মুখোশগুলো স্থানীয় সংস্কৃতি এবং ধর্মীয় বিশ্বাসের বিশেষ কদর রয়েছে।এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো:

  •  বাঁকুড়া জেলায়:- রাবনকাটা মুখোশ
  •  মালদা জেলায়:- গম্ভীরা মুখোশ
  •  উত্তর ও দক্ষিণ দিনাজপুরে: -গোমিরা মুখোশ
  •  দার্জিলিংয়ে:- বাগপা মুখোশ , ইত্যাদি।

 আজ আমরা গোমিরা নৃত্য নিয়ে আলোচনা করছি। গোমিরা দিনাজপুরের একটি প্রাচীন ও ঐতিহ্যবাহী লোকনৃত্য। যেখানে মুখোশ পরে দেবতাকে তুষ্ট করতে এবং অশুভ শক্তি তাড়ানোর জন্য গ্রামবাসীরা নৃত্য পরিবেশন করে।
গোমিরা-নৃত্য.jpg
গোমিরা রাতের দৃশ।

গোমিরা দিনাজপুরের একটি প্রাচীন ও ঐতিহ্যবাহী লোকনৃত্য। যেখানে মুখোশ পরে দেবতাকে তুষ্ট করতে এবং অশুভ শক্তি তাড়ানোর জন্য গ্রামবাসীরা নৃত্য পরিবেশন করে। 
 
গোমিরা-নৃত্য.jpg
গোমিরা নৃত্য
মুখোশ তৈরি এবং মুখোশ নাচ মানব সভ্যতার অত্যন্ত প্রাচীন ঐতিহ্য। মুখোশগুলি সুরক্ষা, ছদ্মবেশ, স্বাস্থ্যবিধি এবং নাট্য প্রভাবের জন্য ব্যবহৃত হয়ে এসেছে। প্রাচীনকাল থেকে, মুখোশধারী নাচ ধর্মীয় কর্মকাণ্ডের একটি অবিচ্ছেদ্য অংশ হিসেবে বিবেচিত হয়।

 গোমিরা নাচ কি?

 গোমিরা আঞ্চলিক ভাষায় ‘মুখা খেল’ নামে পরিচিত। 'গোমিরা' শব্দটি ‘গ্রাম চণ্ডী’ বা গ্রাম দেবতা থেকে উদ্ভূত, এবং গোমিরা মুখোশ নৃত্য মূলত এই দেবতার উপাসনার জন্য অনুষ্ঠিত হয়। মাঠের ফসল তোলার সময় এই আরাধনা করা হয়, যেখানে অশুভ শক্তিকে বিনাশ করতে এবং দেবতাদের তুষ্ট করে আশীর্বাদ ও শুভ শক্তির আহ্বান জানানো হয়।

gomira-dance.jpg
অশুভ শক্তিকে বিনাশ করতে

 গোমিরা একটি 'বোড়ো' শব্দ, এবং গবেষক শিশির মজুমদারের মতে, 'বোড়ো' সম্প্রদায় থেকেই রাজবংশী সম্প্রদায়ের উদ্ভব। উত্তরবঙ্গের দিনাজপুর ভৌগোলিক অঞ্চলে রাজবংশী দেশি-পলি সমাজ গোমিরা বা মুখা খেলার সঙ্গে গভীরভাবে যুক্ত। এই নাচের নামকরণ সম্ভবত গামার গাছ থেকে হয়েছে, যা দিয়ে মুখোশ তৈরি করা হয়। যদিও লোকমুখে বিভিন্ন গল্প প্রচলিত রয়েছে, তবে এর সঠিক লিখিত ইতিহাস এখনো খুঁজে পাওয়া যায়নি।

gomira-dance.jpg
শিল্পীরা বিশেষ পোশাকে

 গোমিরার বিশেষ দুটি  রূপ রয়েছে:

 1. গোমিরা নৃত্য :গোমিরা একটি ঐতিহ্যবাহী মুখোশধারী নৃত্য, যা মূলত দেবতা উপাসনা এবং সাংসারিক মঙ্গল কামনার উদ্দেশ্যে পরিবেশিত হয়। এই নাচের মাধ্যমে অশুভ শক্তির বিরুদ্ধে প্রতীকী যুদ্ধ দেখানো হয় এবং দেবতাদের আশীর্বাদ প্রার্থনা করা হয়।

gomira-dance.jpg
গোমিরা রাতের দৃশ।

2. রাম-বনবাস রূপ: রাম-বনবাস গোমিরা নৃত্যের একটি বিশেষ রূপ, যা রামায়ণের বাণ কাণ্ডকে চিত্রিত করে। গ্রামবাসীদের বিশ্বাস, ঈশ্বর মনুষ্য রূপে পৃথিবীতে অবতীর্ণ হয়েছিলেন, যাতে তিনি মানুষের মঙ্গল সাধন করতে পারেন এবং অশুভ শক্তির বিরুদ্ধে তাঁদের সহায়তা করতে পারেন।

gomira-dance.jpg
গোমিরা নৃত্য পরিবেশনার জন্য শিল্পীরা বিশেষ পোশাক পরিধান করছে।

গোমিরা শিল্পীরা কোথায় থাকেন :

👥গোমিরা নর্তকীদের প্রধানত পশ্চিমবঙ্গের দুটি জেলায় দেখা যায় - উত্তর ও দক্ষিণ দিনাজপুর। 

  •  উত্তর দিনাজপুরে:- শিল্পীরা কালিয়াগঞ্জ ব্লকের চন্দোল, কৃষ্ণবাটি এবং ভেলাইতে, সেইসাথে ইটাহার ব্লকের থিলবিল এবং গোয়ালগাঁওয়ে কেন্দ্রীভূত।  

গোমিরা-নৃত্য.jpg
গোমিরা শিল্পীরা বিশ্রাম করছে একটি দোকানে।
  দক্ষিণ দিনাজপুরে:- কুশমন্ডি ব্লকের অধীন মহিষবাথান এবং খাগড়াইলের পাশাপাশি হরিরামপুর ব্লকের চাকলা, যমুনা এবং বরোগ্রামেও গোমিরা পরিবেশনকারীদের দেখতে পাবেন। 
gomira-dance.jpg
গোমিরা নৃত্য শিল্পীদের পরিবহন

 গোমিরা নৃত্য পরিবেশিত হয় ?

'গোমিরা' নৃত্যের জন্য কোনো পূর্ব-নির্ধারিত দিনপঞ্জি উল্লেখ নেই। মাঠের ফসল কাটার মরসুমে 'অশুভ শক্তি' তাড়াতে ও সাংসারিক মঙ্গল কামনায় গ্রামাঞ্চলে গোমিরা আয়োজন করা হয়।সাধারণত, 'চৈত্র সংক্রান্তি' বা চৈত্র মাসের শেষ দিকে হয়। বৈশাখ, জৈষ্ঠ, এবং আষাঢ় জুড়ে বিভিন্ন মেলা ও উৎসবে মধ্যে নৃত্যশিল্পীরা পরিবেশন করেন।

গোমিরা-নৃত্য.jpg
গোমিরা নাচ
 এই নাচের প্রধান দুটি চরিত্র হলো 'বুড়া-বুড়ি'। যাদের 'শিব 'ও 'পার্বতীর' রূপে দেখা হয়। বিশেষত কুশমণ্ডির রাজবংশী সম্প্রদায় এই কাঠের মুখোশকে উপাসনার প্রতীক হিসেবে দেখে।প্রায়শই, গ্রামবাসীরা তাদের মনোবাসনা পূরণের জন্য, গ্রাম দেবতার কাছে প্রার্থনা করে এবং একটি গোমিরা মুখোশ দেওয়ার মানদ করেন।
gomira-dance.jpg
গোমিরা নাচ

গোমিরা নাচের মুখোশগুলি তৈরি :গোমিরা নাচের মুখোশগুলি একক কাঠের খণ্ড দিয়ে তৈরি করা হয়। একটি বড় ও মোটা কাঠের খণ্ডে হাতুড়ি এবং বাটালি ব্যবহার করে কাঙ্ক্ষিত মুখের রূপ দেওয়া হয়। ঐতিহ্যগতভাবে গামারি, নিম কাঠ বা অন্যান্য প্রকারের কাঠ ব্যবহৃত হয়। তবে বেশিরভাগ ক্ষেত্রে 'গামার' কাঠ ব্যবহার করা হয়। কাঠের মুখোশের ওজন সাধারণত ২-৩ কিলোগ্রাম হয়ে থাকে। মাঝে মাঝে কাগজ এবং 'শোলা' থেকেও গোমিরার মুখোশ তৈরি করা হয়।

gomira-dance.jpg
শিল্পীরা নিজেই মুখোশ তৈরি করেন

  মহিষবাথান গ্রামীণ হস্তশিল্প সমবায় সমিতি ঐতিহ্যবাহী প্রথা ধরে রাখার পাশাপাশি হস্তশিল্পকে তুলে ধরতে প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল। শুরুতে মাত্র ২৭ জন শিল্পী নিয়ে পথচলা শুরু হলেও, পরবর্তীতে হস্তশিল্পকেই জীবিকা হিসেবে বেছে নেন। বর্তমানে শিল্পীদের সংখ্যা ৫০০ ছাড়িয়ে গেছে এবং মুখোশের খ্যাতি দেশ-বিদেশে ছড়িয়ে পড়েছে।পর্যটকদের আকর্ষিত করতে অনেক উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। গোমিরা নাচের পারফরম্যান্সের জন্য শিল্পীরা নিজেই মুখোশ তৈরি করেন। এই মুখোশ তৈরির প্রক্রিয়া তাদের দীর্ঘকালীন ঐতিহ্য এবং দক্ষতার ফলাফল।

    gomira-dance.jpg
    নিজেই মুখোশ তৈরি করেন

 গোমিরা নাচের মুখোশ: ঐতিহ্য ও ইতিহাস

 গোমিরা নাচের মুখোশের ধরন বিভিন্ন, পৌরাণিক চরিত্রকে উপস্থাপন করে।যা এই নৃত্যের একটি গুরুত্বপূর্ণ অংশ। কিছু আকর্ষণীয় মুখোশের ধরন হল:

gomira-dance.jpg
বুড়া' এবং 'বুড়ি' মুখোশ

  • 'বুড়া & বুড়ি':বাংলায় 'বুড়া' এবং 'বুড়ি' শব্দগুলির অর্থ বৃদ্ধ এবং বৃদ্ধা মহিলা। গোমিরা নৃত্যে, বৃদ্ধ ও বৃদ্ধার জোড়া মুখোশ ভগবান শিব এবং দেবী পার্বতীর মানব অবতারের প্রতিনিধিত্ব করে। নৃত্যশিল্পীরা এই মুখোশ পরে নাচ করেন।ঐতিহ্যগতভাবে, গোমিরা নৃত্য শুরু হয় 'বুড়া-বুড়ি' চরিত্রগুলির মঞ্চে প্রবেশের মাধ্যমে। এই চরিত্রগুলি একে অপরের হাত  ধরে রাখে এবং হাস্যকর ভঙ্গি সহ একটি ধীরগতির নাচ করে। বাংলার 'মঙ্গল' সাহিত্যে শিবকে প্রায়ই কমিক রিলিফ দিতে দেখা যায়, এবং মনে করা হয় যে এই নৃত্যটি 'মঙ্গল' সাহিত্যের একটি সংকেত বহন করে।
    gomira-dance.jpg
    বাগ মুখোশ

  • বাগ:বাংলা ভাষায় 'বাগ' মানে 'বাঘ'। 'বাঘা' চরিত্রটি সাধারণত 'বুড়া-বুড়ি'-এর পরে মঞ্চে উপস্থিত হয়। 'বাগ' দর্শকদের বিনোদনের জন্য বিভিন্ন অ্যাক্রোবেটিক চাল পরিবেশন করে। নর্তকী একটি বাঘের মুখোশ এবং কালো-হলুদ ডোরাকাটা পোশাক পরেন। এই চরিত্রটি মঞ্চে সজীবতা এবং উত্তেজনা যোগ করে, দর্শকদের মনোরঞ্জন করে এবং নৃত্যের প্রদর্শনীর এক বিশেষ অংশ হিসেবে কাজ করে।
    gomira-dance.jpg
    শ্মশান কালী বা মাসান কালী মুখোশ
  • শ্মশান কালী বা মাসান কালী : হিন্দু পৌরাণিক কাহিনী অনুসারে, শ্মশান কালী বা মাসান কালীর একটি বিশেষ রূপ, যিনি চন্দ এবং মুন্ডা নামক দুটি অসুরকে বধ করেছিলেন। গোমিরা নৃত্যে শ্মশান কালী বা চামুন্ডা কালী একটি গুরুত্বপূর্ণ চরিত্র।শ্মশান কালী বা চামুন্ডা কালীর মুখোশ সাধারণত বড় ও বিস্তৃত হয়। সাধারণত, ২-৪ জন নর্তকী একই সাথে শ্মশান কালী বা চামুন্ডা কালী চরিত্রে পরিবেশন করেন। তারা মুখোশের সাথে রঙিন 'ঘাগরা' বা ঐতিহ্যবাহী স্কার্ট পরে থাকেন। শ্মশান কালী বা চামুন্ডা কালীর প্রবেশের সাথে সাথে মঞ্চের পরিবেশ গুরুতর হয়ে ওঠে। নৃত্যশিল্পীরা বিশেষভাবে কোমর বাঁকিয়ে এবং মাটিতে থাপানোর সাথে সাথে সংগীতের গতি দ্রুত হয়।
    gomira-dance.jpg
    শ্মশান কালীর সঙ্গী ডাকিনী মুখোশ
  • ডাকিনী: এই চরিত্রটিকে শ্মশান কালী বা চামুন্ডা কালীর সঙ্গী হিসেবে বিবেচনা করা হয়। ২-৪ জন নৃত্যশিল্পী ডাকিনী ভূমিকায় অভিনয় করেন।নৃত্যশিল্পীরা তাদের শরীর কালো করে এবং শাড়ি থেকে তৈরি 'ঘাগরা' পরেন। তারা চামুন্ডা কালীকে নৃত্যে সঙ্গ দেন এবং তার প্রভাব আরও শক্তিশালী করে তোলেন।
    gomira-dance-mask.jpg
    শ্মশান কালীর সঙ্গী যোগিনী মুখোশ
  • যোগিনী: শ্মশান কালী বা চামুন্ডা কালীর আরেক নারী সঙ্গী। তবে যোগিনী বিশালের মুখোশ ডাকিনী বিশালের মুখোশের তুলনায় বড়।২-৩ জন নৃত্যশিল্পী যোগিনীর পোশাক পরে চামুন্ডা কালীকে সঙ্গ দেন এবং তার সাথে নাচ করেন।
    gomira-dance-mask.jpg
    নর রাক্ষস মুখোশ
  • নর রাক্ষস: এটি গোমিরা নৃত্যের সবচেয়ে ভয়ঙ্কর চরিত্র। একক নর্তকী দ্বারা সঞ্চালিত।নর রাক্ষস একটি অসভ্য দানব রূপ। 

    gomira-dance-mask.jpg
    নৃসিংহের মুখোশ

  • নৃসিংহ:এটি ভগবান বিষ্ণুর দশটি অবতারের একটি। শুধুমাত্র একজন নৃত্যশিল্পী নৃসিংহের মুখোশ পরে দ্রুত গতিতে নাচ করেন। আরও কিছু ধরনের আচে মুখোশ।

    gomira-dance.jpg
     ঢাক, ঢোল, বাঁশি, কাশি, করতাল এবং 'সনাই ও অন্যান্য বাদ্যযন্ত্র

  👉 গমীরা নাচের আগে 'ঘট স্থাপন' একটি গুরুত্বপূর্ণ প্রথা। নাচ শুরু হওয়ার আগে 'দেবংশী' নামক পুরোহিতরা পবিত্র জল, ফুল এবং 'বেল' পাতা ছিটিয়ে 'মন্ত্র' উচ্চারণ করে মুখোশের পূজা করেন। নাচের চরিত্রগুলো একে একে মঞ্চে প্রবেশ করে এবং প্রতিটি চরিত্রের পরিবেশনা শেষ হওয়ার পর 'নর রাখখোস' এবং 'নৃসিংহ' চরিত্রে অভিনয়কারীরা প্রায়ই আবিষ্ট হয়ে পড়েন।

gomira-dance.jpg
সনাই
 গোমিরা মুখোশ নাচ শুধুমাত্র পুরুষ নৃত্যশিল্পীদের দ্বারা পরিবেশন করা হয়। যেখানে নারী চরিত্রগুলো পুরুষের দ্বারা অভিনীত হয়। যদিও এই নাচে নারী চরিত্রের প্রাধান্য থাকে,তা সত্ত্বেও শুধুমাত্র পুরুষ নৃত্যশিল্পীরাই নারী চরিত্রে অভিনয় করেন। মঞ্চে নারীদের প্রবেশ নিষিদ্ধ এবং নাচের আগের দিন ও পরে তারা শুধুমাত্র নিরামিষ খাবার গ্রহণ করে। নাচের দিনে উপবাস পালন করা হয় এবং অভিনয়ের পর ভাপানো 'আতপ' ভাত খাওয়া হয়।
gomira-dance.jpg
নাচের একটি দৃশ্য

গোমিরা নাচের সাথে ঢাক, ঢোল, বাঁশি, কাশি, করতাল এবং 'সনাই ও অন্যান্য বাদ্যযন্ত্র।তবে কোনো গান ব্যবহার করা হয় না।মহিষবাথান গ্রাম, যেটি স্থানীয়ভাবে 'মুখােশ-গ্রাম' নামে পরিচিত। মুখোশ তৈরির জন্য বিশেষ খ্যাতি লাভ করেছে।২০১৮সালে কুশমন্ডির কাঠের মুখোশ 'জিওগ্রাফিক্যাল ইন্ডিকেশন্স' (GI) ট্যাগ পায়।পূর্বপুরুষদের ঐতিহ্য বজায় রেখে শিল্পীরা গামারি কাঠ দিয়ে নানা প্রকারের পৌরাণিক চরিত্রের মুখোশ বানাতেন।শিল্পীরা বিশ্বাস করেন, মুখোশ পরার সঙ্গে সঙ্গে সেই মুখ জীবন্ত হয়ে ওঠে। বাড়ির বাচ্চাদের খেলার ছলে, বংশপরম্পরায় হাতেখড়ি হয়।

gomira-dance.jpg
মুখোশ পরার সঙ্গে সঙ্গে সেই মুখ যেন জীবন্ত হয়ে ওঠে।

১৯৯০ সালের পর মহিষবাথান গ্রামীণ হস্তশিল্প সমিতি প্রতিষ্ঠিত হয় এবং ১৯৯৫ সালে এটি সরকারিভাবে নথিভুক্ত হয়। গামারি, শাল, আম, পাকুড়, মেহগনি প্রভৃতি কাঠের মুখোশ গমীরা নাচে ব্যাপকভাবে ব্যবহৃত হয়।সরকারি উদ্যোগে কুশমন্ডিতে গমীরা-মুখোশ তৈরির কেন্দ্র গড়ে উঠেছে এবং ২০১৪ সাল থেকে 'মুখা মেলা' শুরু হয়েছে। এই মেলায় প্রদর্শনী, বিক্রি, খনগান, ভাওইয়া গান এবং মুখা নাচের আসর জমে ওঠে।

gomira-dance.jpg
বাড়ির বাচ্চাদের খেলার ছলে।

গোমিরা নৃত্যশিল্পীরা সাধারণত দরিদ্র শ্রেণীর অন্তর্ভুক্ত এবং কৃষক, ক্ষেতমজুর হিসেবে জীবন যাপন করেন। 'লোকপ্রসার প্রকল্পে' রাজ্য সরকারের তরফে গোমিরা নৃত্য শিল্পীদের দেওয়া হচ্ছে ভাতা।

gomira-dance.jpg
খেলার ছলে বংশপরম্পরায় হাতেখড়ি।

 গোমিরা নাচ দেখতে পৌঁছানোর পদ্ধতি:

দক্ষিণ দিনাজপুরের গঙ্গারামপুর বা উত্তর দিনাজপুরের কালিয়াগঞ্জে গোমিরা মুখোশধারী নৃত্য উপভোগ করতে গেলে:

gomira-dance.jpg
দিনাজপুরের কালিয়াগঞ্জে
 গঙ্গারামপুরে পৌঁছানোর জন্য:

🚊 হাওড়া - বালুরঘাট এক্সপ্রেস (13063): সকালের দিকে ছাড়বে।
🚊 কলকাতা - বালুরঘাট তেভাগা এক্সপ্রেস (13161): দুপুরের দিকে ছাড়বে।।
🚊 গৌর এক্সপ্রেস বালুরঘাট লিঙ্ক (13153): রাতের দিকে ছাড়বে।

🚌 এছাড়াও, প্রতিদিন কলকাতা থেকে বালুরঘাটে এনবিএসটিসি (N.B.S.T.C.) এবং ভলভো বাস পরিষেবা উপলব্ধ।

কালিয়াগঞ্জে যাওয়ার জন্য: রাধিকাপুর এক্সপ্রেস (13145): সন্ধ্যার দিকে কলকাতা স্টেশন থেকে ছাড়বে।

🚌 এছাড়াও, কলকাতা থেকে রায়গঞ্জের N.B.S.T.C. বাস পরিষেবা ব্যবহার করে কালিয়াগঞ্জে পৌঁছানো সম্ভব।

  •  সূত্র:
        1.বাঙালির ঐতিহ্য ও সংস্কৃতি” - প্রণব কুমার চক্রবর্তী
        2.সরকারী নথি ও প্রতিবেদন:Intangible Cultural Heritage of West Bengal - Government of West Bengal
       3. লোকমুখে পাওয়া তথ্য।
  • (বিশেষ দ্রষ্টব্য:কিছু ছবি বন্ধুদের কাছ থেকে সংগ্রহ করা হয়েছে।)

Post a Comment

0Comments

We welcome thoughtful discussions. Comments are moderated for quality

Post a Comment (0)

#buttons=(Ok, Go it!) #days=(20)

Our website uses cookies to enhance your experience. Check Now
Ok, Go it!