বীরনগর, নদীয়া জেলার একটি ঐতিহাসিক জনপদ, যেখানে বুদ্ধ পূর্ণিমা উপলক্ষে এক বিশাল লোকজ উৎসবের আয়োজন হয়। ধর্মীয় ভক্তি, লোককথা ও প্রাচীন ইতিহাসে আচ্ছন্ন এই জনপদের পুরনো নাম ছিল উলা। এখানে রয়েছে উলাইচণ্ডী দেবীর মন্দির, বারোয়ারি পুজো, টেরাকোটা শিল্পে ভরপুর মন্দির এবং মুঘল যুগের স্মৃতি বিজড়িত মিত্র মুস্তাফি পরিবার।
🔶 উলাইচণ্ডী কে?
লোকবিশ্বাস অনুযায়ী, উলাইচণ্ডী দেবী ওলাওঠা বা কলেরা রোগের প্রতিরোধকারী এক লৌকিক দেবী। গাছে মানতের ঘোড়া বাঁধা থাকে, যা বিশ্বাস এবং মানতের প্রতীক।
🔶 শ্রীমন্ত সওদাগরের কাহিনি
এক লোককথা অনুসারে, বণিক শ্রীমন্ত সওদাগর সিংহলে বাণিজ্য করতে গিয়ে উলায় প্রাকৃতিক দুর্যোগে পড়েন এবং সেই ভয় থেকে মুক্তি পেতে বুদ্ধ পূর্ণিমার দিন উলাইচণ্ডী দেবীর পূজা করেন। সেই থেকে এই তিথিতে এই পূজার প্রচলন।
🌕 বুদ্ধ পূর্ণিমা ও উলাইচণ্ডী পূজা: লোকবিশ্বাস ও বীরনগরের মেলা ঐতিহ্যবুদ্ধ পূর্ণিমার দিনটি বীরনগরে শুধু বৌদ্ধ ধর্ম নয়, লোকধর্মেরও এক গুরুত্বপূর্ণ তিথি। এখানে পাঁচশো বছরের পুরনো উলাইচণ্ডী মায়ের বার্ষিক পূজা অনুষ্ঠিত হয় এই দিনেই। বৈশাখ মাসের শুক্লপক্ষের পূর্ণিমা তিথিতে এই পূজার আয়োজন করা হয়। বুদ্ধ পূর্ণিমার দিন বীরনগরের হাজার হাজার ভক্ত এই মেলায় ভিড় জমান। কথিত আছে যে শ্রীমন্ত সওদাগর সিংহল যাত্রায় প্রাকৃতিক দুর্যোগ থেকে নিজেকে রক্ষা করার জন্য ভাগীরথী নদীর তীরে উলাই চণ্ডী মা পূজা করেছিলেন। সেই থেকে প্রতি বছর এই পূজা পালিত হয়ে আসছে। উলাই চণ্ডী মা প্রধানত কলেরা বা কলেরা নিরাময়কারী দেবী হিসেবে পূজা করা হয়। পূজার সময়, স্থানীয় থান এলাকার অনেক বট গাছের ডালে ব্রতের ঘোড়া বেঁধে দেওয়া হয়।এই পূজায় পশু বলির ঐতিহ্য রয়েছে।
বুদ্ধ পূর্ণিমার দিনে উলাই চণ্ডীর পাশাপাশি পূজিত হন বিন্ধ্যবাসিনী এবং মহিষমর্দিনী মা। বীরনগরের বিখ্যাত বারোয়ারিগুলির মধ্যে রয়েছে বড়বাজার, মধুগাছিপাড়া, বেলেডাঙ্গাপাড়া এবং ছোটবাজার । এই পূজা ঐতিহ্যবাহী দুর্গাপূজা থেকে কিছুটা ভিন্ন, কারণ গণেশ ও কার্তিক দেবতার পূজা হয় না, তবে বড়বাজারের পূজায় লক্ষ্মী ও সরস্বতী পূজিত হন।
![]() |
বড়বাজার বারোয়ারি বিন্ধ্যবাসিনী মাতা ও লক্ষ্মী-সরস্বতী |
📜 উলা থেকে বীরনগর: এক ইতিহাসের সন্ধান
‘উলা’ নামটির উৎস নিয়ে
বিভিন্ন মতভেদ থাকলেও, অনেকে মনে করেন এটি এসেছে উলুখড়ের বন থেকে। একসময়
এখান থেকে গোটা দক্ষিণবঙ্গে উলুখড় সরবরাহ হত। ব্রিটিশ আমলে ডাকাতদের রুখতে
স্থানীয় যুবকদের বীরত্ব দেখে ইংরেজরা এই স্থানের নাম রাখে “বীরনগর”।
🏛️ বীরনগরের প্রাচীন মন্দির ও ঐতিহাসিক স্থাপত্য
বীরনগরের ইতিহাস বিজড়িত স্থানগুলির মধ্যে উল্লেখযোগ্য মিত্র-মুস্তাফি পরিবারের অক্ষয় কীর্তি। ১৬৫৭ সালে শান্তিপুরের মোহন মিত্র ও তার ভাইরা উলাতে এসে স্থায়ী বসবাস শুরু করেন। রামেশ্বর মিত্র মুস্তাফি ছিলেন এই বংশের খ্যাতিমান পুরুষ, যিনি ১৭০৪ সালে মুঘল সম্রাট ঔরঙ্গজেবের কাছ থেকে 'মুস্তফি' উপাধি পেয়েছিলেন।
মিত্র-মুস্তাফি পরিবারের উত্তর-পূর্বে অবস্থিত বিষ্ণু মন্দির ছিল বীরনগরের সবচেয়ে প্রাচীন মন্দির। যদিও বর্তমানে এটি ধ্বংসাবশেষের আকারে রয়েছে, টেরাকোটার কিছু অক্ষয় ভাস্কর্য আজও দেখা যায়। এছাড়া পঞ্চরত্ন উলাশঙ্কর শিব মন্দির এবং রাধা-কৃষ্ণ মন্দিরও ঐতিহ্যবাহী স্থান।
✅ বিষ্ণু মন্দির
মোহন মিত্রের ভাই কাশীশ্বর মিত্র নির্মাণ করেন উত্তর-পূর্ব কোণে অবস্থিত বিষ্ণু মন্দির, যা বর্তমানে ধ্বংসাবশেষ হলেও টেরাকোটা শিল্প আজও সাক্ষ্য বহন করে।
![]() |
জোর বাংলার মন্দির |
Auto Update Headline with Modern 3D Effect
লোড হচ্ছে...
✅ রাধা-কৃষ্ণ মন্দির
জোর বাংলার আঙ্গিকে নির্মিত এই মন্দিরটি বিষ্ণুপুর ধাঁচে তৈরি। ভিতরে আজও রাধাকৃষ্ণের বিগ্রহ পূজিত হয়।
![]() |
উলাশঙ্কর পঞ্চরত্ন শিব মন্দির |
সর্ব্বঞ্জপাড়ায় অবস্থিত একটি অপরূপ মন্দির যা এলাকার আর একটি পুরনো ধন।
🔚 উপসংহার
বীরনগর, তার বৌদ্ধ উৎসব, লৌকিক দেবীর আরাধনা, ঐতিহাসিক মন্দির এবং মিত্র-মুস্তাফি বংশের গৌরবগাথা মিলে এক অনন্য সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য বহন করছে। বুদ্ধ পূর্ণিমা উপলক্ষে এই অঞ্চল যেন হয়ে ওঠে ইতিহাস ও ধর্মের এক মিলনক্ষেত্র। তাই এবছর যদি বুদ্ধ পূর্ণিমায় কোথাও ঘুরতে যাওয়ার কথা ভাবেন — বীরনগর হোক আপনার গন্তব্য।
🚉 বীরনগর ভ্রমণের জন্য গাইড:
এর পরেই আপনার গন্তব্য বীরনগর স্টেশন।বীরনগর স্টেশন থেকে, আপনি উলাই চণ্ডী তলায় হেঁটে যেতে পারেন অথবা টোটো নিয়ে যেতে পারেন, ভাড়া ১০ টাকা। এছাড়াও, দর কষাকষির মাধ্যমে একটি টোটো রিজার্ভ করে, আপনি সমস্ত বারোয়ারি পূজা মন্দির এবং মিত্র-মুস্তফির ঐতিহাসিক নিদর্শনগুলিও পরিদর্শন করতে পারেন।তবে, আমার অভিজ্ঞতায়, পুরো ভ্রমণটাই ঘুরে বেড়ানোর পায়ে হেঁটে ।
We welcome thoughtful discussions. Comments are moderated for quality