Palpara Terracotta Temple,Palpara, Nadia পালপাড়া টেরাকোটা মন্দির, ১৭শ শতকের স্থাপত্যের বিস্ময়

Palpara Terracotta Temple,Palpara, Nadia পালপাড়া টেরাকোটা মন্দির, ১৭শ শতকের স্থাপত্যের বিস্ময়

By LalPecha.in Editorial Desk
0

পালপাড়া টেরাকোটা মন্দিরের সামনের দৃশ্য

টেরাকোটা মন্দির 📍 পালপাড়া, নদীয়া, পশ্চিমবঙ্গ

লেখক Blue Tick

রাজু বিশ্বাস

ব্লগার | লেখক |ছাত্র

📍 ভারত (India)

Blue Tick Approval

📰 : পালপাড়া টেরাকোটা মন্দির পশ্চিমবঙ্গের নদীয়া জেলায় অবস্থিত এক অতি মূল্যবান ঐতিহাসিক ও ধর্মীয় নিদর্শন। ভারতীয় পুরাতত্ত্ব বিভাগ এই মন্দিরটিকে “রাষ্ট্রীয় গুরুত্বপূর্ণ স্মারক” হিসেবে ঘোষণা করে। এটি চারচালা ঢান যুক্ত মন্দিরগুলোর মধ্যে সমগ্র জেলা ও আঞ্চলিক পর্যায়ে অত্যন্ত বিশেষ ও অনন্য স্থাপন।
 
মন্দিরের স্থাপত্য ও টেরাকোটা অলংকরণ : মন্দিরটির দৈর্ঘ্য প্রায় ২৬ ফুট, প্রস্থ ২১ ফুট এবং উচ্চতা ৪০ ফুট। এটি আয়তাকার ভিত্তিতে নির্মিত এবং দক্ষিণমুখী। মন্দিরটি উচ্চবেদীর ওপর অবস্থিত, যেখানে চারচালা ছাউনি রয়েছে। প্রবেশদ্বারের উপরে ও পাশে টেরাকোটা অলংকরণ খুব সূক্ষ্ম ও জীবন্তভাবে খোদাই করা হয়েছে।

পালপাড়া মন্দিরের প্রধান প্রবেশপথ

এখানে বিশেষভাবে রামায়ণের কাহিনী ফুটে উঠেছে, যেখানে রাম ধনুক হাতে রাবণ, কৃষ্ণভর্ণ এবং রাক্ষস সৈন্যদের সঙ্গে যুদ্ধরত অবস্থায় ফুটিয়ে তোলা হয়েছে। এছাড়াও ফুল, পাতা ও ডালের নকশা অত্যন্ত দক্ষতার সাথে অলংকৃত রয়েছে। অন্যদিকে সামনের ও পেছনের দেওয়ালে টেরাকোটার ফলক ছড়িয়ে রয়েছে, যা ঐতিহাসিক ও ধর্মীয় ঐতিহ্যের প্রমাণ বহন করে।

 টেরাকোটা অলংকরণ:পালপাড়া মন্দিরের বিশেষ আকর্ষণ এর সূক্ষ্ম টেরাকোটা কারুকাজ। প্রবেশদ্বারের ডান, বাম এবং উপরের অংশে টেরাকোটার মনোরম শিল্পকর্ম দেখা যায়।

উল্লেখযোগ্য দৃশ্যসমূহ:

🏛️  রামায়ণ থেকে রাম-রাবণের যুদ্ধের চিত্রণ:

🏺 বাঁদিকে তির-ধনুক হাতে রামচন্দ্র।

🏺 ডানদিকে দশানন রাবণ যুদ্ধে প্রস্তুত।

🏺 রাবণের পাশে বিশালাকার রাক্ষস ও বানরসেনার সম্মুখযুদ্ধের দৃশ্য।

🏛️তোরণপথ অলংকরণ:

🏺 চারপাশে বহু দু'মুখো সাপ (বা ড্রাগন) খোদাই করা।

🏛️অন্য অলংকরণ: 

🏺 প্রবেশদ্বার ও কার্নিসের নিচে ফুল-পাতার সূক্ষ্ম নকশা।

🏺পশ্চিম দেওয়ালের পশ্চাদভাগেও বহু টেরাকোটা ফুলের কাজ।

টেরাকোটা মন্দির

ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপট:

পালপাড়া মন্দিরের নির্মাণকাল নির্দিষ্টভাবে জানা না গেলেও, এটি মুসলিম পরবর্তী যুগে নির্মিত বলে প্রতীয়মান হয়। মন্দিরের অভ্যন্তরের ছাদ গম্বুজাকৃতির হওয়ায় এই ধারণা প্রতিষ্ঠিত হয়েছে।
স্থানীয় মতে, এই মন্দির জনৈক গন্ধর্ব রায় দ্বারা প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল বলে বিশ্বাস করা হয়।

১৮৯৪ খ্রিস্টাব্দের ১৩ ই ডিসেম্বর, নদিয়ার তৎকালীন জেলা প্রশাসক (কালেক্টর) একটি মন্দির স্থাপত্যটি পরিদর্শনে আসেন। তাঁর সুপারিশে তৎকালীন ব্রিটিশ সরকার এই মন্দিরের সংরক্ষণের জন্য ৫০০ টাকা বরাদ্দ করে। এরপর থেকেই মন্দিরটি এক সরকারি-স্বীকৃত সংরক্ষিত ছিল।

এই ঘটনার দুই বছর পরে, অর্থাৎ ১৮৯৬ খ্রিস্টাব্দে প্রকাশিত হয় ঐতিহাসিক গ্রন্থ "List of Ancient Monuments in Bengal"। বইটির ১১৭ নম্বর পৃষ্ঠায় স্পষ্টভাবে উল্লেখ করা হয়েছে যে, মন্দিরটির তৎকালীন মালিক ছিলেন পালপাড়ার বাবু কালীকুমার চৌধুরী। একই বইয়ে মন্দিরটিকে ৫০০ বছরের প্রাচীন বলেও উল্লেখ করা হয়।

তথ্যসূত্র অনুযায়ী, ১৮৯৬ সালেও এই মন্দিরে কোনো বিগ্রহ বা দেবমূর্তির দেখা যায়নি। —যা ব্যতিক্রমী বৈশিষ্ট্য হিসেবেই ধরা যায়।

বিশিষ্ট মন্দির গবেষক ও ইতিহাসবিদ অধ্যাপক David G. McCutchin  তাঁর আলোচিত গ্রন্থ Late Mediaeval Temples of Bengal-এর ৩১ নম্বর পৃষ্ঠায় এই মন্দিরটি সম্পর্কে বিশ্লেষণ করতে গিয়ে মত দেন—এর নির্মাণকাল সম্ভবত ১৭শ শতক।

অবশ্য স্থানীয় জনশ্রুতি অনুযায়ী, অনেকের ধারণা—নদিয়ারাজ রাঘব রায়ই এই মন্দির নির্মাণের পেছনে ছিলেন। যদিও এ বিষয়ে চূড়ান্ত প্রমাণ মেলেনি, তবে স্থাপত্যরীতি ও নির্মাণশৈলী সেই সময়কার রাজকীয় অনুরূপ। অনেকে অনুমান করে বলে কালী মন্দির , আবার কেও বলেন শিব মন্দির। 

বর্তমানে এই মন্দির ভারতীয় পুরাতত্ত্ব সর্বেক্ষণ (ASI)-এর সরাসরি তত্ত্বাবধানে সংরক্ষিত। সম্প্রতি মন্দিরের রক্ষণাবেক্ষণ ও আংশিক সংস্কারও করা হয়েছে যাতে তার ঐতিহাসিক গরিমা অটুট থাকে।

টেরাকোটা মন্দির

আইনগত সুরক্ষা ও গুরুত্ব

পালপাড়া মন্দির “প্রাচীন স্মারক ও পুরাতাত্ত্বিক স্থল এবং অবশেষ আইন, ১৯৫৮” ও সংশোধিত আইন ২০০০ অনুযায়ী “রাষ্ট্রীয় গুরুত্বপূর্ণ স্মারক” হিসেবে সংরক্ষিত।
এই স্মারক ধ্বংস, অপসারণ বা পরিবর্তন করলে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তি ২ বছরের কারাদণ্ড অথবা ১ লক্ষ টাকা জরিমানা বা উভয় শাস্তির আওতায় পড়তে পারেন।

টেরাকোটা মন্দির

ভৌগোলিক অবস্থান / স্থাপত্য বৈশিষ্ট্য:
🛕 মুখ: দক্ষিণমুখী
🧱  গঠন: উঁচু ভিত্তিবেদির উপর নির্মিত
◻️ প্রকৃতি: আয়তাকার মন্দির
উচ্চতা: আনুমানিক ১২ মিটার (৪০ ফুট)
🎨 নির্মাণ সামগ্রী: ইঁট
📍অবস্থান: পালপাড়া, নদীয়া জেলা, পশ্চিমবঙ্গ
🗺️অক্ষাংশ ও দ্রাঘিমাংশ: ২৩°০৩′৩০.৩৫" উত্তর, ৮৮°৩১′০১.০২" পূর্ব

টেরাকোটা মন্দির

 পর্যটন ও দর্শনীয় স্থান হিসেবে গুরুত্ব:

পালপাড়া মন্দির তার স্থাপত্য ও টেরাকোটা অলংকরণে সমৃদ্ধ হওয়ায় পর্যটক ও ইতিহাসপ্রেমীদের কাছে বিশেষ আকর্ষণ। বাংলার স্থানীয় সংস্কৃতি ও ঐতিহ্যের দর্শনীয় স্থান হিসেবে এই মন্দির অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। এছাড়া এটি নদীয়া জেলার ঐতিহ্যবাহী স্থাপত্যশৈলীর অমূল্য নিদর্শন।

কীভাবে পৌঁছাবেন এই প্রাচীন টেরাকোটা মন্দিরে?

🚆 রেলপথে:

শিয়ালদহ-রানাঘাট শাখার ট্রেনে উঠে সরাসরি পালপাড়া স্টেশনে নেমে পড়ুন (দূরত্ব প্রায় ৬০ কিমি)। শিয়ালদহগামী দিকের কম্পার্টমেন্টে থাকলে স্টেশন থেকে বেরিয়ে রেলগেট পার হতে সুবিধা হবে। সেখান থেকে পশ্চিম দিকে মাত্র পাঁচ মিনিট হাঁটলেই পৌঁছে যাবেন দুর্গানগর তারকদাস বিদ্যামন্দিরের পাশেই অবস্থিত, নদিয়ার অন্যতম প্রাচীন টেরাকোটা মন্দিরে।

🚗 সড়কপথে:
রানাঘাট বা নদিয়া জেলার যেকোনো প্রান্ত থেকে গাড়িতে করে সহজেই পৌঁছাতে পারেন পালপাড়ায়। রাস্তা মোটামুটি ভালো।

টেরাকোটা মন্দির
🌤️ ভ্রমণের সেরা সময়:
শীত বা বসন্তকালে ভ্রমণ সবচেয়ে উপভোগ্য। বর্ষাকালে কাদা ও ভেজা পরিবেশে অসুবিধা হতে পারে।  
টেরাকোটা মন্দির
পালপাড়া মন্দির

উপসংহার: পালপাড়া টেরাকোটা মন্দির শুধুমাত্র একটি ধর্মীয় স্থান নয়, এটি বাংলার ঐতিহাসিক ও সাংস্কৃতিক সম্পদের অমূল্য অংশ। এর সৌন্দর্য ও নৈপুণ্য বাংলা টেরাকোটা শিল্পকলার একটি অনন্য উদাহরণ হিসেবে বিবেচিত। এই স্মারককে সঠিকভাবে সংরক্ষণ ও রক্ষা করা আমাদের দায়িত্ব, যাতে ভবিষ্যৎ প্রজন্মও বাংলার ঐতিহ্যের এই মহৎ নিদর্শন উপভোগ করতে পারে।

Post a Comment

0Comments

We welcome thoughtful discussions. Comments are moderated for quality

Post a Comment (0)

#buttons=(Ok, Go it!) #days=(20)

Our website uses cookies to enhance your experience. Check Now
Ok, Go it!