১৬৬ বছরের ঐতিহাসিক যাত্রার ইতি: ভারতের রেল থেকে বিদায় নিল এডমন্ডসন হলুদ টিকিট

১৬৬ বছরের ঐতিহাসিক যাত্রার ইতি: ভারতের রেল থেকে বিদায় নিল এডমন্ডসন হলুদ টিকিট

লালপেঁচা 🟥 ইন ডেস্ক |
1

edmondson-railway-ticket.jpg


“দাদা দু’টো রানাঘাট দিন তো!” — একসময় এভাবে হলুদ পিচবোর্ড টিকিট হাতে পেতেন যাত্রীরা। বুকিং ক্লার্ক জালের ফাঁক দিয়ে টাকাটা নিয়ে 'ঘটাস-ঘটাস' করে পাঞ্চিং মেশিনে তারিখ বসিয়ে টিকিট বাড়িয়ে দিতেন। এই চিরচেনা দৃশ্য এখন শুধুই স্মৃতি।

২০২০ সালের মে মাসে ভারতীয় রেল বন্ধ করে দেয় ১৬৬ বছরের পুরনো হলুদ এডমন্ডসন পিচবোর্ড টিকিটের ছাপা ও ব্যবহার। প্রযুক্তির অগ্রগতির সঙ্গে সঙ্গে রেলের এই ঐতিহাসিক অধ্যায়ের পরিসমাপ্তি ঘটে।

edmondson-railway-ticket.jpg
টমাস এডমন্ডসন
 

কী ছিল এডমন্ডসন টিকিট?

এই বিশেষ টিকিটের উৎপত্তি ১৮৪০ সালে ইংল্যান্ডে। টমাস এডমন্ডসন, নিউক্যাসলের এক স্টেশন মাস্টার, প্রথমবারের মতো এমন একটি পিচবোর্ড টিকিট তৈরি করেন যা নির্দিষ্ট মাপের হতো — ২.২৫ ইঞ্চি × ১.২২ ইঞ্চি

ভারতে এই টিকিটের যাত্রা শুরু হয় ১৮৫৩ সালে মুম্বই থেকে থানে ট্রেন চলাচলের সময়। এরপর দেশের প্রতিটি কোণে রেলস্টেশনে এই হলুদ টিকিট হয়ে ওঠে যাত্রীদের নিত্যসঙ্গী।

indian-railway-ticket.png
লোহার পাঞ্চিং মেশিনে  তারিখ দেওয়া হচ্ছে

এটি সাধারণত হলুদ রঙের পিচবোর্ডে ছাপা হতো। তাতে ট্রেন নম্বর, যাত্রার তারিখ, স্টেশন, ভাড়া ইত্যাদি কালো কালি দিয়ে ছাপা থাকত। বুকিং ক্লার্করা একটি লোহার পাঞ্চিং মেশিনে তারিখ খোদাই করে টিকিট যাত্রীদের হাতে তুলে দিতেন।

কোথায় রাখা হতো টিকিটগুলো?

প্রতিটি স্টেশনে একটি কাঠের “এডমন্ডসন ক্যাবিনেট” থাকত, যার প্রতিটি খোপে বিভিন্ন গন্তব্যের টিকিট সাজানো থাকত। চাহিদা অনুযায়ী সেখান থেকে টিকিট নিয়ে পাঞ্চ করে দেওয়া হতো।

 indian-railway-ticket.png

কেন বন্ধ হলো এই টিকিট?

প্রযুক্তির বিকাশ ও ডিজিটাল ব্যবস্থার প্রসারের সঙ্গে সঙ্গে এডমন্ডসন টিকিটের চাহিদা কমতে থাকে।
বর্তমানে রেল স্টেশনে UTS (Unreserved Ticketing System), ATVM (Automatic Ticket Vending Machine)-এর মাধ্যমে কম্পিউটার প্রিন্টেড কাগজের টিকিট চালু হয়েছে। ফলে ধীরে ধীরে বন্ধ হয়ে যায় এডমন্ডসন টিকিটের ব্যবহার।

অবশেষে ২০২০ সালে রেল মন্ত্রক মুম্বই, হাওড়া, দিল্লি, রোয়াপুরম ও সেকেন্দ্রাবাদ— এই পাঁচটি ছাপাখানাও বন্ধ ঘোষণা করে।

indian-railway-ticket.png
 

এখনও কোথাও দেখা যায়?

ভারতের কিছু প্রত্যন্ত স্টেশন, যেখান থেকে দিনে একশোরও কম যাত্রী টিকিট কাটেন, সেখানে এই টিকিট চালু ছিল। পশ্চিমবঙ্গের বিভিন্ন গ্রামের হল্ট স্টেশন-এ এখনো মাঝেমধ্যে দেখা মেলে এই হলুদ টিকিটের।

indian-railway-ticket.png
 এছাড়া, নীলগিরি মাউন্টেন রেলওয়ে-এর মতো হেরিটেজ ট্রেনে এখনও পর্যটকদের কাছে নস্টালজিয়ার অংশ হিসেবে এই টিকিট দেওয়া হয়।

indian-railway-ticket.png
 নস্টালজিয়ার অংশ: ৯০-এর দশকের স্মৃতি

যারা ৯০-এর দশকে বড় হয়েছেন, তাদের কাছে এই টিকিট শুধুমাত্র যাতায়াতের মাধ্যম ছিল না, বরং খেলার অংশ ছিল। টিকিট জমিয়ে রাখা, বইয়ের পেজমার্ক হিসেবে ব্যবহার, এমনকি পায়ার নিচে চাপ দিয়ে টেবিল সোজা রাখা— সব কিছুতেই এই টিকিটের ব্যবহার ছিল।

indian-railway-ticket.png
 আজকের দিনে প্রযুক্তির জয়

বর্তমানে রেলের অধিকাংশ ব্যবস্থা ডিজিটাল। যাত্রীরা এখন মোবাইল অ্যাপের মাধ্যমে টিকিট কাটছেন, টিকিট কাগজে প্রিন্ট হচ্ছে, QR কোড স্ক্যান হচ্ছে। এর ফলে পুরোনো টিকিটের পাঞ্চিং মেশিন ও ক্যাবিনেট পড়ে থাকছে ধুলোমাখা অবস্থা।

সারসংক্ষেপ

বিষয় তথ্য
টিকিটের নাম                           - এডমন্ডসন টিকিট
শুরু -ইংল্যান্ড, ১৮৪০
ভারতে চালু -১৮৫৩
মাপ -২.২৫ × ১.২২ ইঞ্চি
উপাদান -হলুদ পিচবোর্ড
পদ্ধতি -পাঞ্চিং মেশিনে তারিখ বসিয়ে
অবসান -মে, ২০২০
বর্তমান ব্যবহার -কেবল হেরিটেজ ট্রেন ও জাদুঘর

উপসংহার:
হলুদ এডমন্ডসন টিকিট শুধু একটা টিকিট নয়, তা ভারতীয় রেলের ইতিহাসের এক অবিচ্ছেদ্য অংশ। প্রযুক্তির অগ্রগতিতে এর প্রয়োজন ফুরালেও, স্মৃতির পাতায় চিরকাল রয়ে যাবে সেই ‘ঘটাস-ঘটাস’ আওয়াজ আর বুকিং ক্লার্কের হাসি মুখ

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

1মন্তব্যসমূহ

  1. খুব সুন্দর হয়েছে... ধন্যবাদ দাদা পুরোনো স্মৃতি মনে করিয়ে দেওয়ার জন্য...

    উত্তরমুছুন
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

#buttons=(Ok, Go it!) #days=(20)

Our website uses cookies to enhance your experience. Check Now
Ok, Go it!