গুঁতে মাছ: এক বিস্মৃতপ্রায় দেশীয় সম্পদ
বাংলার নদী, বিল, খাল ও পুকুরে একসময় প্রচুর দেখা যেত নানা প্রজাতির দেশীয় মাছ। তবে সময়ের পরিবর্তনে, জলাশয়ের দূষণ, আধুনিক মৎস্যচাষ এবং প্রাকৃতিক ভারসাম্যহীনতার ফলে কিছু মাছ আজ প্রায় বিলুপ্তির পথে। এরকমই একটি মাছ হলো গুঁতে মাছ, যা বিভিন্ন স্থানে গুঁতেল, রুটি মাছ, পুঁইয়ে বা গোরপুঁ নামেও পরিচিত।
বৈজ্ঞানিক পরিচিতি
বৈজ্ঞানিক নাম: Lepidocephalus guntea (Hamilton)
পরিবার: Cobitidae (লোচা বা লোচন জাতীয় মাছ)
স্থানীয় নাম: গুঁতে, গুঁতেল, রুটি মাছ, পুঁইয়ে, গোরপুঁ
আকৃতি ও গঠন
গুঁতে মাছ দেখতে লম্বাটে ও নলের মতো আকৃতির হয়। মাছটির মুখ নিচের দিকে বাঁকানো এবং মুখের চারপাশে তিন থেকে চার জোড়া ছোট কিন্তু স্পষ্ট শুঁড় থাকে।
আকার: সাধারণত ৪ ইঞ্চি পর্যন্ত লম্বা হয়।
পাখনা:
পিঠের পাখনা (Dorsal fin) একটিই থাকে এবং এটি মাথা ও লেজের মাঝামাঝি অবস্থান করে।
লেজের পাখনা (Caudal fin) লম্বাটে এবং প্রান্ত গোলাকার।
অন্যান্য বৈশিষ্ট্য:
চোখের কোটরের নিচের দিকে একটি বিশেষ দু-মুখো কাঁটা থাকে।
গায়ের রং বিভিন্ন রকম হতে পারে; সাধারণত ঘন বাদামি, হলুদ বা হালকা সাদা রঙের গায়ে কালো ছোপ ছোপ দাগ থাকে।
দেহের মাঝ বরাবর হালকা বা গাঢ় কালো ছিটে দিয়ে তৈরি দাগ দেখা যায়।
আবাস ও জীবনধারা
আবাসস্থল: অল্প জলের নদী, খাল, ঝিল ও পুকুরের নিচের স্তরে বসবাস করে। বিশেষত পলি ও বালিময় জায়গায় এরা বেশি পাওয়া যায়।
খাদ্যাভ্যাস: এরা প্রধানত বেন্টিক (জলের তলায় থাকা খাবার খাওয়া মাছ) স্বভাবের এবং কাদা বা বালির মধ্যে মুখ গুঁজে খাবার খোঁজে। ক্ষুদ্র জলজ কীটপতঙ্গ, জৈব পদার্থ, ছোট শৈবাল ও ব্যাকটেরিয়া এদের প্রধান খাবার।
স্বভাব: গুঁতে মাছ ভয় পেলে দ্রুত কাদা বা জলজ গাছপালার নিচে লুকিয়ে পড়ে। এই সময় এদের গায়ের রং আশেপাশের পরিবেশের সাথে মিশে যায়, যা শিকারীদের চোখে পড়া কঠিন করে তোলে।
মানুষের সাথে সম্পর্ক ও ব্যবহৃতি
খাদ্য: গ্রামের বাজারে অন্যান্য ছোট মাছের সাথে মিশ্রভাবে বিক্রি হতে দেখা যায়। এর মাংস সুস্বাদু হলেও খুব বেশি জনপ্রিয় নয়।
অ্যাকোরিয়াম ফিশ: এদের আকর্ষণীয় দেহগঠনের কারণে অনেকেই অ্যাকোরিয়ামে রাখতে পছন্দ করেন।
লোকজ বিশ্বাস: গ্রামবাংলায় একসময় ছোট বাচ্চারা এই মাছের চোখের কাঁটা খুলে কানের দুলের সাথে আটকে মজা করত।
গুঁতে মাছের সঙ্গে সদৃশ প্রজাতি
অনেক সময় সাধারণ মানুষের কাছে গুঁতে মাছকে অন্য মাছের সঙ্গে গুলিয়ে ফেলার প্রবণতা দেখা যায়। তবে গুঁতে মাছের নলাকার দেহ, নিচের দিকে বাঁকানো মুখ এবং স্পষ্ট শুঁড়ের জন্য একে সহজেই চেনা যায়।
লোচা মাছের (Loach fish) সাথে সামঞ্জস্য:
গড়ন অনেকটা লোচা মাছের মতো হলেও গুঁতে মাছের গায়ে স্পষ্ট দাগ থাকে।
লোচা মাছ তুলনামূলক বেশি মসৃণ ও লম্বাটে হয়।
ছোট কৈ মাছের সাথে পার্থক্য:
কৈ মাছের তুলনায় গুঁতে মাছ অনেক বেশি সরু ও নলাকার।
কৈ মাছের মুখ উপরদিকে থাকলেও গুঁতে মাছের মুখ নিচের দিকে বাঁকানো।
পরিস্থিতি ও সংরক্ষণ
একসময় বাংলার প্রায় প্রতিটি জলাশয়ে প্রচুর পরিমাণে গুঁতে মাছ দেখা যেত। তবে বর্তমানে বিভিন্ন কারণে এদের সংখ্যা কমে গেছে।
সংখ্যা হ্রাসের কারণ:
জলদূষণ ও রাসায়নিক সার-বিষ প্রয়োগ।
জলাশয় শুকিয়ে যাওয়া ও প্রাকৃতিক আবাসস্থল ধ্বংস।
অতিরিক্ত মাছ ধরা ও অসচেতনভাবে জাল ব্যবহার।
সংরক্ষণে করণীয়:
✅ দেশীয় মাছ সংরক্ষণে সচেতনতা বৃদ্ধি করা। ✅ জলাশয় রক্ষা করা ও কৃত্রিম প্রজনন পদ্ধতি অনুসরণ করা। ✅ ক্ষুদ্র প্রজাতির মাছের ওপর নির্ভরশীল পরিবেশগত ভারসাম্য রক্ষা করা। ✅ অতিরিক্ত মাছ ধরা ও অপরিণত মাছ শিকার বন্ধ করা।
উপসংহার
গুঁতে মাছ বাংলার জলজ সম্পদের একটি অবিচ্ছেদ্য অংশ। একসময় এটি প্রচুর পরিমাণে দেখা গেলেও বর্তমানে তা অনেকটাই দুর্লভ হয়ে উঠেছে। সঠিক সংরক্ষণ নীতি ও পরিবেশগত সচেতনতা গড়ে তুলতে পারলে হয়তো আবারও বাংলার নদী-নালা ও খালবিলে এই মাছের সমৃদ্ধি ফিরে আসবে। দেশীয় মাছের গুরুত্ব বুঝতে হলে, এদের সংরক্ষণের জন্য আমাদেরকেই উদ্যোগী হতে হবে।
🔹 আপনার মতামত জানাতে কমেন্ট করুন এবং শেয়ার করুন, যাতে আরো মানুষ দেশীয় মাছ সংরক্ষণে সচেতন হয়!
We welcome thoughtful discussions. Comments are moderated for quality