বাহান্ন পাগল: নশিরকুলি ও বাগাদাঙ্গার নীল পুজো – একটি ঐতিহ্যবাহী আধ্যাত্মিক উৎসব

বাহান্ন পাগল: নশিরকুলি ও বাগাদাঙ্গার নীল পুজো – একটি ঐতিহ্যবাহী আধ্যাত্মিক উৎসব

লালপেঁচা.in – বাংলার না-বলা কথা
0

bahanno-pagol.jpg
চৈত্র মাসে নীল পূজা "বাহান্ন পাগল": লুপ্তপ্রায় ঐতিহ্যের সাংস্কৃতিক ও আধ্যাত্মিক দিকসমূহ

বাহান্ন পাগল উৎসবের ইতিহাস

‘বাহান্ন পাগল’ উৎসবের উৎপত্তি পূর্ববঙ্গের নোয়াখালীর জিরতলী গ্রামে। সেখানে দাস-জেলে সম্প্রদায়ভুক্ত অর্ধশতটি পরিবারের মধ্যে পালিত হলেও, ভারত-বিভাগের পর সম্প্রদায়টি ছিন্নমূল হয়ে নদিয়া, বর্ধমান, ত্রিপুরাসহ বিভিন্ন স্থানে ছড়িয়ে পড়ে। হিন্দুস্তান-পাকিস্তান ভাগের পর থেকে পশ্চিমবঙ্গের নদিয়া জেলার নাশেরকুলি ও বাঘাডাঙ্গা গ্রামে এই অনুষ্ঠানটি পুনরায় সংগঠিত হয়ে পালিত হচ্ছে। আজ পুরো গ্রাম জাতপাত উঁচু-নিচু ভেদাভেদ ভুলে এই অনুষ্ঠানে অংশগ্রহণ করে, এই আনন্দে সকলে সামিল হয়।

নদীয়া জেলার লোক সংস্কৃতি

bahanno-pagol.jpg
শিব, দুর্গা ও গঙ্গার রূপে পুরুষ সন্ন্যাসীরা

উৎসবের প্রধান আচার-অনুষ্ঠান:

  🧩 সন্ন্যাস গ্রহণ: চৈত্র মাসের মাঝামাঝি সময়ে চুল, দাড়ি ও নখ ছেঁটে, নদী বা পুকুরে স্নান করে আত্মশুদ্ধি সাধন করা হয়। শনিবার অথবা মঙ্গলবার বার 'বান', 'বড়শি', ও 'ত্রিশূল' পুজোর মাধ্যমে শুরু হয় সন্ন্যাস গ্রহণের পর্ব। সন্ন্যাসীরা দিনে ফলমূল এবং সূর্যাস্তের পর নিরামিষ আহার করেন ও কঠোর নিয়ম মেনে চলেন।
  🧩 নীল ষষ্ঠী পূজা: প্রধান পূজার দিন শিব, দুর্গা ও গঙ্গার রূপে পুরুষ সন্ন্যাসীরা সাজেন এবং "ঢাক, কাঁসর ও অন্যান্য বাদক যন্ত্রের ছন্দে বিশেষ নৃত্যানুষ্ঠানে সামিল হয়ে, সকাল থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত সন্ন্যাসীরা গ্রামে প্রত্যেকটি বাড়িতে মুষ্টিভিক্ষা বা টাকা-পয়সা সংগ্রহ করেন এবং শিব, দুর্গা, পার্বতীর সঙ্গে 'বাহান্ন পাগল' অর্থাৎ সমাজের প্রতিচ্ছবিতে সেজে পুরো গ্রাম পরিভ্রমণ করেন।
  🧩 শিব, দুর্গা ও গঙ্গার রূপে যে মানুষদের পূজা করা হয়, তাঁদের ঈশ্বররূপে গণ্য করা হয়। শিবরূপী ব্যক্তির চরণ স্পর্শ করে ছোট-বড় সকলেই আশীর্বাদ গ্রহণ করেন। গৃহস্থের বাড়িতে গেলে তাঁদের পূজিত করা হয়, এবং এই পূজার পৌরোহিত্য করেন ‘বালা সন্ন্যাসী’। প্রসাদ হিসেবে দুধ ও কলা প্রদান করা হয়। যাঁরা শিব, দুর্গা ও গঙ্গার রূপে পূজিত হন, তাঁদের মূলত দাস-জেলে সম্প্রদায়ভুক্ত হতে হয় এবং বৈষ্ণব মতাদর্শ অনুযায়ী গুরু-মন্ত্রে দীক্ষিত হওয়া আবশ্যক।
বাহান্ন-পাগল.jpg
সামাজিক চরিত্রের সাজগোজ
🧩 অন্যদিকে, বাহান্ন পাগলের সজনীরা যেকোনো জাতিগোষ্ঠীর হতে পারেন। নিরামিষ আহার গ্রহণ করে তাঁরাও এই আচার-অনুষ্ঠানে সক্রিয়ভাবে অংশগ্রহণ করতে পারেন। তবে বাহান্ন পাগলের মূল অংশগ্রহণকারীরা সকলেই পুরুষ। নারীদের ‘বাহান্ন পাগল সজনী’ রূপে এই আচার-অনুষ্ঠানে সরাসরি অংশগ্রহণের অনুমতি নেই, তবে তাঁরা পূজার কাজে সাহায্য করতে পারেন এবং বিভিন্ন কার্যক্রমে সহযোগিতা করে অনুষ্ঠানকে সার্থক করে তোলেন।
 
 🧩 বাহান্ন পাগল নৃত্য: গ্রামের বিভিন্ন শ্রেণির মানুষ এই নৃত্যে অংশ নেন, যেখানে নানা সামাজিক চরিত্রের সাজগোজ থাকে, যেমন ডাক্তার, পুলিশ, মুচি, চোর, মাতাল ইত্যাদি।সূর্যাস্তের পর শুরু হয় মূল পূজা। কারো মানস বা মনের ইচ্ছা পূর্ণ হলে, তার বাড়িতে রাতের 'নীল পূজা' অনুষ্ঠিত হয় এবং প্রসাদ ভোজন হয়।

🧩হাজরা পূজা ও ভোজ: নীল পূজাও প্রসাদ গ্রহণের পর, মধ্যরাতে ফাঁকা মাঠে শুরু হয় শিব ও কালির মুখোশ নৃত্য। সেখানেই অনুষ্ঠিত হয় হাজরা পূজা। এরপর হয় ভোজের আয়োজন। সৃষ্টিকর্তা ঈশ্বরকে নিবেদন করা হয় আট রকমের ভাজা এবং শোল মাছ পোড়া।তারপর, সকাল হওয়ার আগে আগে সন্ন্যাসীরা মাঠ থেকে বাড়ি ফিরে বিশ্রাম নেন।

bahanno-pagol.jpg

  🧩পয়লা বৈশাখের মিলন মেলা: নববর্ষের সন্ধ্যায় বাঘাডাঙ্গার কালী মন্দির প্রাঙ্গণে অনুষ্ঠিত হয় 'পয়লা বৈশাখী মিলন মেলা'। এই মেলায় ‘বাহান্ন পাগল’ উৎসবের শিল্পীদের পারিশ্রমিক হিসেবে ‘দক্ষিণা’ প্রদান করা হয়। এই দক্ষিণার অর্থ তাঁরা মেলার বিভিন্ন দোকানে কেনাকাটায় ব্যয় করেন। বিশেষত পাঁপড়, আইসক্রিম, নাগরদোলা এবং অন্যান্য বিনোদনমূলক সামগ্রী ও উপকরণের মাধ্যমে তাঁরা মেলার আনন্দ উপভোগ করেন। এই আনন্দঘন অংশগ্রহণের মধ্য দিয়েই ‘বাহান্ন পাগল’ উৎসব তার পূর্ণতা অর্জন করে।
বাহান্ন-পাগল.jpg

 🧩সামাজিক ও সাংস্কৃতিক প্রভাব  :  বাহান্ন পাগল শুধুমাত্র ধর্মীয় উৎসব নয়, এটি একটি সামাজিক নাট্য ও লোকনাট্যের রূপ। এতে সমাজের বিভিন্ন স্তরের মানুষ অংশগ্রহণ করে এবং এটি শ্রেণিগত বৈষম্য দূর করে ঐক্যের বার্তা দেয়। পুরুষরা দেবতার সাজ ধারণ করেন, আর নারীরা পূজা ও অতিথি আপ্যায়নে সক্রিয় ভূমিকা পালন করেন।

 🧩সংকট ও ভবিষ্যৎ : বর্তমান প্রজন্মের মধ্যে উৎসবের প্রতি আগ্রহ কমে আসছে, এবং সাজ-পরিচ্ছদ ও লোকবল সংকট দেখা দিয়েছে। যথাযথ রক্ষণাবেক্ষণ ও সরকারি-সামাজিক সহযোগিতা ছাড়া এই ঐতিহ্য বিলুপ্তির পথে যেতে পারে। তাই গবেষণা, সংরক্ষণ এবং প্রজন্মান্তরে উৎসবের ধারাবাহিকতা নিশ্চিত করা খুব জরুরি।
 
   উপসংহার : বাহান্ন পাগল একটি জীবন্ত লোকসংস্কৃতির ধারক এবং বহনকারী, যা ধর্ম, সংস্কৃতি, সমাজ ও ইতিহাসকে একত্রিত করে। এটি নদিয়ার নাশেরকুলি ও বাঘাডাঙ্গার মতো গ্রামে মানুষের বিশ্বাস, ভক্তি ও ঐক্যের এক অসাধারণ উদাহরণ। এই উৎসব রক্ষায় আমাদের সকলের সম্মিলিত প্রচেষ্টা দরকার।
 
তথ্যদাতা:যোগেশ্বর দাস (বালা সন্ন্যাসী)


Post a Comment

0Comments

We welcome thoughtful discussions. Comments are moderated for quality

Post a Comment (0)

#buttons=(Ok, Go it!) #days=(20)

Our website uses cookies to enhance your experience. Check Now
Ok, Go it!