![]() |
খঞ্চি গ্রামের বাঁশবাগানে পালিত হচ্ছে কালু রায়ের পূজা |
বাংলার নববর্ষ, যা আমরা **বর্ষবরণ** হিসেবে উদযাপন করি, প্রতিটি গ্রামে গ্রামে একটি নতুন আশার উন্মেষ ঘটায়। বিশেষত গ্রামবাংলার প্রতিটি কোণায় কোণায় মানুষ মেতে ওঠে বিভিন্ন লোকাচার, পূজা, ও পার্বণে। বাংলার বাণী এবং সংস্কৃতির রক্ষায় আঞ্চলিক দেবতাদের পূজার্চনাও প্রাধান্য পায়। এমনই এক ঐতিহ্যবাহী পূজা হচ্ছে **কালু রায়ের আরাধনা**, যা প্রতি বাংলা বছরের প্রথম দিন **খঞ্চি গ্রামে** মহাসাড়ম্বরে অনুষ্ঠিত হয়।
বাংলার লৌকিক দেবতা
কালু রায়: কে এই গ্রাম্য দেবতা?
কালু রায় এমন এক **গ্রাম্য দেবতা**, যিনি বিশেষভাবে গ্রাম বাংলার সাধারণ মানুষের জীবনে গভীরভাবে জড়িত। যদিও কালু রায়ের কোনো নির্দিষ্ট মূর্তি পাওয়া যায় না, তবুও মানুষ তার মনের মাধুরী দিয়ে তাকে বিভিন্ন রূপে উপস্থাপন করেছে। কোথাও তিনি **বাঘের রূপে**, কোথাও **কুমিরের রূপে**, আবার কোথাও **মহিষের রূপে** মূর্তিমান হয়ে ওঠেন। মেদিনীপুরের বঙ্গোপসাগরের উপকূলবর্তী অঞ্চলসহ দক্ষিণবাংলার বিভিন্ন অঞ্চলে এই দেবতার পূজা হয়।
কালু রায়ের জনপ্রিয়তা ও পূজার আচার
কালু রায়ের পূজার্চনা একটি গ্রামীণ ঐতিহ্য যা **বারুজীবী সম্প্রদায়ের** মধ্যে বিশেষভাবে প্রচলিত। এই পূজা গ্রাম্য মানুষদের জীবনে একটি গুরুত্বপূর্ণ স্থান দখল করে রয়েছে, বিশেষত **ডোম, বাগদী ও বারুইদের** মধ্যে। খঞ্চি গ্রামে প্রতি বছর পালা করে পূজা অনুষ্ঠিত হয়। পূজার সময়, কালু রায়ের রূপ হয় ক্ষুধার্ত বাঘের মতো। গ্রামে **মহিষের দেবতা** হিসেবে কালু রায় পূজা পাওয়া যায়, তবে কোথাও কোথাও তাকে **বাঘের দেবতা** হিসেবেও পূজিত করা হয়।
![]() |
বারুজীবী সম্প্রদায়ের পূজাস্থলে প্রতীকী রূপে পানবরজ নির্মিত হয়। |
এই পূজা সাধারণত তেমন কোনো বাহুল্য ছাড়াই হয়। নৈবেদ্য হিসেবে ফলমূল, কলা, ও আতপচাল দেওয়া হয়। তবে পূজার সময় এক বিশেষ ধরনের ছড়া প্রচলিত আছে, যা এই অঞ্চলের লোকাচারে একটি জনপ্রিয় রীতিতে পরিণত হয়েছে:
কালুরায় বনবিবি দক্ষিণরায়
📜 জনপ্রিয় ছড়া ও আঞ্চলিক উচ্চারণ:
“উত্তর-দক্ষিণ রায়ে রাখি দুই পাশে
মধ্যস্থলে জ্যেষ্ঠ কালুরায় বসে।
সবার দক্ষিণে চন্ডী বামেতে মঙ্গলা,
পঞ্চরূপে পৃথিবীতে করেন লীলাখেলা।
কোথা একা, কোথা তিন, কোথা পঞ্চজন
নির্ভয়েতে কালুরায় করেন বিচরণ।
ঘরবাড়ি নাহি কিছু বাস বৃক্ষতল,
সদাচিন্তা কি যে হবে গ্রামের মঙ্গল।
বন্দো কালু রায়ে সবে গ্রামের দেবতা
গ্রামের ভরসা বিপদেতে রক্ষাকর্তা।”
কালু রায়ের মূর্তির প্রতীক ও পূজার স্থান
পশ্চিমবঙ্গের উপকূলবর্তী অঞ্চল, বিশেষ করে **মেদিনীপুরে**, কালুরায় এক রহস্যময় অথচ শক্তিশালী **লোকদেবতা**। তিনি **মহিষের দেবতা** রূপে পূজিত হন এবং গ্রামীণ সমাজে তাঁর প্রভাব আজও পরিলক্ষিত হয়।
কালুরায়ের কোনও স্থায়ী মন্দির নেই। সাধারণত **গাছতলা বা বাঁশঝাড়ের তলায়** কয়েকটি গোলাকার **প্রস্তরখণ্ড** স্থাপন করে তাঁর পূজা হয়। কোথাও একটি, কোথাও তিনটি, আবার কোথাও বা পাঁচটি প্রস্তরখণ্ড কালুরায়ের প্রতীক হিসেবে ব্যবহৃত হয়।
আজ আমরা তুলে ধরছি **পূর্ব মেদিনীপুর জেলার ‘খঞ্চি’ গ্রামের** এক ব্যতিক্রমী লোকাচার।
এই অঞ্চলে কালুরায়ের পূজায় উচ্চারিত হয় **মহাকাল ভৈরবের মন্ত্র**। এই মন্ত্র যেন মানুষের অন্তর্লীন ভয়, বিশ্বাস ও প্রকৃতির সঙ্গে সহাবস্থানের চিত্র তুলে ধরে। কালুরায়ের ডানদিকে স্থাপিত হন **দক্ষিণরায় ও চণ্ডী**, আর বামদিকে থাকেন **উত্তররায় ও মঙ্গলাদেবী**।
অনেক জায়গায় **দক্ষিণরায়ের মতোই কালুরায়ের মূর্তিও** পাওয়া যায়। এই মূর্তিতে অস্ত্রধারী, শক্তিশালী এক পুরুষরূপে তিনি প্রতিভাত হন—যার রূপ বাঘের মতো ভয়ঙ্কর হলেও উদ্দেশ্য মানবকল্যাণ এবং পবিত্রতার রক্ষা।
মনে করা হয়, কালুরায়ের জন্মলগ্নে এক অধিকার রক্ষার কাহিনি লুকিয়ে আছে—যা আর কেবল মিথ নয়, এক বাস্তব সামাজিক ইতিহাসের প্রতিফলন।
মেদিনীপুরের অনেক এলাকার নামেই **মহিষের অস্তিত্বের প্রমাণ** পাওয়া যায়, যেমন—**মহিষাদল, মহিষগোট** প্রভৃতি। এটি ইঙ্গিত করে যে কালুরায়ের সঙ্গে মহিষপালনের সম্পর্ক একসময় কতটা ঘনিষ্ঠ ছিল।
পূজার অনার্য দেবতা
কালু রায়ের পূজা মূলত **অনার্য দেবতা** হিসেবে করা হয়, যেখানে তার মূল প্রতীক হলো **বাঘের মূর্তি**। এই দেবতার পূজা, শুধু পূজা নয়, বরং একটি সামাজিক ঐতিহ্য। খঞ্চি অঞ্চলের "**মৌদগল্য**" গোত্রভুক্ত কয়েকটি **বারুজীবী পরিবার** প্রতিবছর পালা করে মহাসমারোহে এই পূজা আয়োজন করে।
ঘন বাঁশবাগানের আলো-ছায়ায় প্রতিবছর কাদামাটি দিয়ে তৈরি ভয়ঙ্কর **বাঘের মূর্তিতে** এই দেবতার আরাধনা করা হয়। এখানকার বারুজীবীরা বিশ্বাস করেন, এই অনার্য দেবতা তাদের **পান বরজ রক্ষা করেন বাঘের বেশে**। তাই এখানকার কালু রায়ের রূপ ক্ষুধার্ত বাঘের মতো।
এমনকি খড়, বাঁশের কঞ্চি, সুপারি পাতা সহযোগে একটি ছোটখাটো **প্রতীকী পান বরজও** তৈরি করা হয়। খঞ্চি অঞ্চলের **বারুজীবী সম্প্রদায়** বিশ্বাস করে, পূজার মাধ্যমে তারা কালু রায়ের রূপে ভরসা পায় এবং জীবনের বিপদ-আপদ থেকে মুক্তি লাভের আশা করে। কালু রায়ের পূজার্চনা গ্রাম্য ঐতিহ্য ও লোকশিল্পের এক বিরল মেলবন্ধন, যা প্রতিটি গ্রামবাসীকে তার শিকড় ও সংস্কৃতির সাথে গভীরভাবে যুক্ত রাখে।
[ তবে বলে রাখি, **কালু রায়ের মূর্তির** খোঁজ মিলেছে কোথাও কোথাও। **দক্ষিণ রায়ের মতোই** এর মূর্তি একেবারে পৌরাণিক যুদ্ধ-দেবতার মতো। পোশাক অতন্দ্র প্রহরীর মতো। দুই হাতে টাঙ্গি ও ঢাল, কোমরবন্ধে নানা রকম অস্ত্রশস্ত্র ঝোলানো, পিঠে তীর ধনুক। মূলত **ডোম, বাগদী, বারুইদের আরাধ্য দেবতা** ইনি।]
🌟 কালুরায় পূজার বৈশিষ্ট্য:
উপাদান | তথ্য |
---|---|
পূজার স্থান | গাছতলা, বাঁশঝাড় |
প্রতীক | গোলাকার প্রস্তরখণ্ড (১/৩/৫টি),যুদ্ধ অবতার &বাঘের বেশে |
বাহন | মহিষ (যমের বাহন) |
নৈবেদ্য | কলা, আতপচাল, ফলমূল ইত্যাদি |
সহদেবতা | দক্ষিণরায়, বনবিবি, মঙ্গলাদেবী, চণ্ডী, উত্তররায় |
মূল উদ্দেশ্য | কুমির ও বন্যপশুর হাত থেকে রক্ষা (বিশেষত পান বরজ) |
দেবতা কালুরায়: মিথ ও লোকজ ইতিহাসের সংমিশ্রণ
লোকবিশ্বাসে আছে, **কালুরায়** ছিলেন জ্যেষ্ঠ ভাই। তিনি ‘**উত্তর রায়**’ ও ‘**দক্ষিণ রায়**’-এর সঙ্গে মালিকানা সংক্রান্ত বিবাদে জিতে যান। উত্তর রায় ও দক্ষিণ রায় আলাদা হয়ে যান—যার মধ্যে **দক্ষিণ রায়** আজও **বাঘের দেবতা** রূপে পূজিত। কালুরায়ের জয় ছিল একপ্রকার **মানব সমাজের অধিকার প্রতিষ্ঠার গল্প**। এই মিথে বাঘ (দক্ষিণ রায়) হারে মহিষ (কালুরায়)-এর কাছে—যেখানে মানুষ ও গৃহপালিত পশুর জয় প্রাকৃতিক হিংস্রতাকে প্রতিহত করে।
🔚 উপসংহার:
কালুরায় কেবল একজন দেবতা নন, তিনি বাংলার লোকজ সমাজের গভীর বিশ্বাস, প্রকৃতির সঙ্গে সহাবস্থান এবং আত্মরক্ষার মানসিকতার এক প্রতীক। সভ্যতা যতই এগোক, কালুরায়ের মতো আঞ্চলিক দেবতারা আমাদের সংস্কৃতির শিকড়ে বারবার টেনে নিয়ে যায়।
চিত্র ও তথ্যসূত্র — সামাজিক মাধ্যম এবং স্থানীয় ব্যক্তিবর্গের থেকে প্রাপ্ত।
We welcome thoughtful discussions. Comments are moderated for quality