লেখক: রাজু বিশ্বাস | সূত্র: Lalpecha.in
স্থান: ঘোষপুর | বিষয়বস্তু: লোকচিকিৎসা, গ্রামীণ অর্থনীতি।
✤ ভূমিকাঃ
বহুকাল ধরে, বাংলায় লোকবিশ্বাস এবং ঐতিহ্যবাহী পদ্ধতির উপর ভিত্তি করে বিভিন্ন চিকিৎসা ব্যবস্থা গড়ে উঠেছে। আজও, আধুনিক চিকিৎসা বিজ্ঞানের পাশাপাশি অনেকেই এই অলৌকিক বা ঐতিহ্যবাহী প্রতিকারের উপর নির্ভর করে।
উত্তর চব্বিশ পরগনার মসলন্দপুর গ্রামের ঘোষপুর মাঠপাড়া এলাকার বাসিন্দা 'লক্ষ্মী মণ্ডল' নামে এক বৃদ্ধা মহিলা ''হাড়ভাঙা বুড়িমা'' নামে পরিচিত। প্রায় সকলেই তার আসল নাম ভুলে গেছেন। স্থানীয়দের অনেক জিজ্ঞাসা করার পরেও তার আসল নাম জানা যায়নি, কারণ সবাই তাকে 'হাড়ভাঙা বুড়িমা' বিখ্যাত নামে চেনে। স্থানীয়রা বিশ্বাস করেন যে তিনি ফুঁ দিয়ে এবং তেল মালিশের মাধ্যমে ভাঙা হাড় ঠিক করতে পারেন এবং শরীরের বিভিন্ন ব্যথা ও যন্ত্রণা থেকে মুক্তি পেতে পারেন।
✤ যাত্রাপথ ও সহজ যোগাযোগঃ
মসলন্দপুর রেলওয়ে স্টেশনে পৌঁছানোর পর, ভ্যান স্ট্যান্ডটি প্ল্যাটফর্ম নম্বর ১ এর ঠিক পাশে। সেখান থেকেই শুরু হয় ঘোষপুর যাত্রা। ভ্যানচালকরা গলা চড়িয়ে বলেন—"হাড়ভাঙা বুড়িমা, হাড়ভাঙা বুড়িমা!"
৪-৫ জন যাত্রী থাকলে সাইকেল ভ্যান বা মোটরচালিত ভ্যানে যাত্রা শুরু হয়। ভাড়া ১৫ টাকা নির্ধারণ করা, কিন্তু কম যাত্রী থাকলে চালকরা অতিরিক্ত ৫-১০ টাকা দাবি করেন। পৌঁছতে মাত্র ১০-১২ মিনিট সময় লাগে।
✤ কে এই ‘হাড় ভাঙা বুড়ি’?
লক্ষ্মী মণ্ডল, দেখতে মনে হয় বয়সে তিনি ষাটের কোঠা পার করে এখন সত্তরের দিকে এগোচ্ছেন। তিনি মছলন্দপুর অঞ্চলের এক প্রান্তিক পরিবারের সদস্য। তাঁর আটটি সন্তান — চার মেয়ে ও চার ছেলে। ছোট ছেলে শিমুলকে সঙ্গে নিয়ে তিনি তাঁর নিজস্ব পদ্ধতিতে চিকিৎসা চালিয়ে যাচ্ছেন। স্থানীয়দের দাবি, তিনি ওপার বাংলা (বর্তমান বাংলাদেশ) থেকে আনুমানিক 'দুই -কুড়ি' বছর আগে এপারে এসেছেন।
তাঁর নাম যদিও ‘লক্ষ্মী’, তবে গ্রামের মানুষ থেকে শুরু করে দূর-দূরান্তের লোকজন তাঁকে ‘হাড়ভাঙা বুড়ি’ নামেই চেনে।
লোকমুখে প্রচলিত, বহু বছর আগে তাঁর পরিবারের এক সদস্য হঠাৎই স্বপ্নে এক অলৌকিক “মন্ত্র” বা “ফুঁ-এর শক্তি” লাভ করেন এবং একটি বিশেষ গুল্মজাতীয় গাছের শিকড়ের সন্ধান পান। সেখান থেকেই এই চিকিৎসা পদ্ধতির যাত্রা শুরু হয়, যা প্রজন্মের পর প্রজন্ম ধরে চলে আসছে।
লক্ষ্মী দেবী নিজেকে এই ঐতিহ্যের তৃতীয় প্রজন্ম বলে দাবি করেন। তিনি তার মায়ের কাছ থেকে, উত্তরাধিকারসূত্রে পেয়েছিলেন এই চিকিসা পদ্ধতি ।
✤ চিকিৎসা পদ্ধতি ও রোগের তালিকাঃ
বুড়িমার চিকিৎসা পদ্ধতি সম্পূর্ণ লোকজ ও ভেষজ নির্ভর। স্থানীয়দের মতে, চিকিৎসার প্রধান দুটি মাধ্যম:
-
ফুঁ দেওয়া: রোগীর আক্রান্ত স্থানে তিনি কিছু মন্ত্র উচ্চারণ করে ফুঁ দেন।বিশ্বাস করা হয়, এই ফুঁ-তে এক ধরনের অলৌকিক শক্তি রয়েছে যা ব্যথা উপশমে সহায়তা করে।
-
তেল মালিশ: তিনি তার নিজস্ব ভেষজ ঔষধ ব্যবহার করেন - যা তিনি রোগীর আনা সরিষার তেলের সাথে কয়েক ফোঁটা গোপন উপাদানের সাথে মিশিয়ে রোগী কে দেন।তিনি বলেন, এই তেল ব্যথাযুক্ত স্থানে মালিশ করতে। এবং ব্যথা কমাতে সাহায্য করে এই তেল ।👉সঙ্গে X-ray বা ডাক্তারের প্রেসক্রিপশন মেনে ক্যালসিয়াম ট্যাবলেট খাওয়ার পরামর্শও দেন,
👉 তিনি বিশেষ করে হাড় ভাঙা, গাঁটের ব্যথা, মচকে যাওয়া, কোমরের ব্যথা ইত্যাদির জন্য রোগীদের কাছে জনপ্রিয়। রোগীর গলায় একটি কালো সুতোতে গাছের শিকড় বেঁধে পরিয়ে দেন।এছাড়াও, তিনি হাঁপানি, অর্শ ইত্যাদির চিকিৎসা করে।
চিকিৎসা করেনঃ
👉হাড় ভাঙা👉বাতজ ব্যথা
👉হাঁপানি
👉জয়েন্টে ব্যথা
👉চট পাওয়া ব্যথা
👉পাইলস (আর্শ)
👉চর্মরোগ
রোগী দেখেন সপ্তাহে দু’দিন—শনিবার ও মঙ্গলবার।
বিশেষ করে শনিবারে ভিড় উপচে পড়ে। ভোর ৫টা থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত চলে রোগী দেখা।
✤ চিকিৎসার বিনিময়ে পারিশ্রমিক?
তার দক্ষতা প্রায় নিখুঁত - স্থানীয়রা বলে, "দক্ষিণা মাত্র ১৬ আনা।" তিনি সরাসরি কোনও টাকা দাবি করেন না।রোগীরা তাদের সামর্থ্য অনুযায়ী টাকা দেন। কেউ কেউ ১০ টাকা, কেউ ৫০ টাকা, কেউ কেউ ১০০ টাকাও দেন—তারা নিজেরাই এটি একটি বেতের ধামা-তে রেখে যান।
✤ সামাজিক ও সাংস্কৃতিক প্রভাব
হিন্দু-মুসলিম নির্বিশেষে সকলেই উপকৃত হন ‘হাড়ভাঙা বুড়িমা’র চিকিৎসায়।এই ভিড় শুধু মছলন্দপুর এলাকার সীমায় সীমাবদ্ধ নয়—বসিরহাট, হাবরা, বারাসাত, নদিয়া জেলা তো বটেই, এমনকি রাজ্যের বাইরের বিভিন্ন প্রান্ত থেকেও মানুষ আসেন তাঁর চিকিৎসা নিতে।
✤ অর্থনীতি ও সামাজিক প্রভাবঃএই লোকচিকিৎসা আজ ঘোষপুর গ্রামে এক সমৃদ্ধ গ্রামীণ অর্থনীতির কেন্দ্রবিন্দু:
👉হাড়ভাঙা বুড়িমার বাড়ির আশেপাশে গড়ে উঠেছে ১০-১২টি দোকান
👉টিফিন হোটেল
👉টোটো-ভ্যান পার্কিং ও চার্জিং স্টেশন
👉মুড়ি-ঘুগনি-চটপটি বিক্রেতা
👉সরিষার তেলের বোতলের দোকান (তেলের দাম ১০ টাকা থেকে ৫০ টাকা পর্যন্ত)
স্থানীয় জনগণ বলেন: “মাস দুয়েক আগে আমার ভাইয়ের পা মচকে যায়। ডাক্তার দেখানোর আগে বুড়িমার কাছে নিয়ে যাই। উনি তেল মালিশ করে ফুঁ দিলেন। সপ্তাহখানেকেই পা ঠিক হয়ে গেল।”
অন্যদিকে, সচেতন মানুষদের কিছু অংশ বলেন: “এগুলো মনস্তাত্ত্বিক ফল হতে পারে। তবে এই বিশ্বাস দীর্ঘদিন ধরে গ্রামবাংলার সংস্কৃতির অংশ।”
অর্থাৎ এটি একদিকে যেমন লোকবিশ্বাসের প্রতিফলন, তেমনই এর কার্যকারিতা বিজ্ঞানের মানদণ্ডে যাচাই করা হয়নি—এ কথা স্মরণ রাখা জরুরি।
✤ পরম্পরা ও ভবিষ্যৎঃ
লক্ষ্মীদেবীর চার কন্যা ও চার পুত্র। তাঁদের মধ্যে কনিষ্ঠ পুত্র শিমুল বাবু এই চিকিৎসায় মা’কে সাহায্য করেন।
তিনি জানান,
“এই শিকড়ের গাছ আমরা কোথাও চাষ করি না। ঠাকুমা বলতেন, চাষ করলে গাছ নিষ্ফলা হবে। তাই জমির পুরনো আল, জঙ্গল বা বাগান থেকে সংগ্রহ করি।”
এই লোকজ ঔষধির কাহিনিতে হিন্দু-মুসলিম ভেদ নেই।দুই সম্প্রদায়ের মানুষ সমান আস্থায় ভিড় করেন বুড়িমার বাড়িতে।
✤ উপসংহারঃ 'হাড়ভাঙা বুড়িমা' শুধু একজন লোকচিকিৎসক নন, তিনি আজ বাংলার মাটিতে এক বিশ্বাস, এক সংস্কৃতি ও এক বিকল্প অর্থনীতির প্রতীক।তাঁর চিকিৎসা-পদ্ধতির সার্থকতা কেবল রোগ সারানোতেই নয়, বরং চারপাশের সমাজ-অর্থনীতিকে সক্রিয় ও বাঁচিয়ে রাখার ক্ষমতায়।
We welcome thoughtful discussions. Comments are moderated for quality