আজকে সপরিবারে গিয়েছিলাম বেলে-বিষ্ণুপুরের খেদাইতলার সাপের মেলা দেখতে ও মনসা পুজো দিতে।প্রায় ৩৪০–৩৫০ বছরের পুরোনো এই মেলা। সঠিক দিন জানা না গেলেও, এই মেলাকে ঘিরে বেশ কিছু লোককথা প্রচলিত আছে।
🟢 ইতিহাস ও লোককাহিনিঃ
শোনা যায়, খেদাই নামে এক ব্যক্তি একবার পাট কাটতে গিয়েছিলেন শালকির বিলে। সেখানে হঠাৎ এক বিশাল বিষধর সাপ তাকে দংশন করে। তিনি ভয়ে কাঁপতে কাঁপতে বাড়ি ফিরতে থাকেন।বাড়ি ফেরার পথে মাঠে মধ্যে তিনি একটি কুলগাছে একাধিক সাপ ঝুলতে দেখেন, ওই একই ধরণের।
ঘটনা তিনি স্ত্রী ও মাকে জানালে, তারা কুলগাছের নিচে মনসা দেবীর নাম করে কলার খোলায় দুধ ও কলা দিয়ে মানত করেন। এরপর ওঝা-কবিরাজ ডাকলেও কেউ চিকিৎসা করতে রাজি হয়নি। নিরুপায় হয়ে রাত কাটাতে হয়েছিল তার। সেই রাতে তার এক আত্মীয় কে স্বপ্নে মা মনসা দেখা দিয়ে পূজার আদেশ দেন। যেমন কথা, তেমন কাজ—পরের দিনে শ্রাবন সংক্রান্তি। পূজা দেবার পর 'কাটিঘাঁ' খেদাই সুস্থ হয়ে ওঠেন।
এই কথা জানা জানি হবার পর থেকে ওই কুলগাছের নিচে গ্রামবাসীরা মনসা পুজো শুরু করে। ধীরে ধীরে সেই জায়গা খেদাই কুল তলা বা খেদাইতলার মেলা নামে পরিচিত হয়। শালকির বিলে পশে অবস্থান হওয়ায় একে অনেকে শালকির মেলাও বলে।
🟢 বিশেষত্বঃসাপ ও সাপুড়ে।
খেদাইতলার মেলার প্রধান আকর্ষণ হলো সাপ ও সাপুড়েরা। সারা বছর শনি ও মঙ্গলবার এখানে পূজা হলেও, শ্রাবণ মাসের সংক্রান্তিতে বিশেষ পূজার আয়োজন হয়। এই সময় পশ্চিমবঙ্গের এবং ভারতের বিভিন্ন জেলা থেকে বেদে-বেদিনীরা নানা ধরনের সাপ নিয়ে খেলা দেখাতে বা ভিক্কা করতে আসেন।তবে বন্যপ্রাণী সংরক্ষণ আইনের কারণে আগের মতো সাপুড়েদের ভিড় আর দেখা যায় না। ফলে মেলার ঐতিহ্য কিছুটা ফিকে হয়েছে।
এখানে কোনো মূর্তি নেই—আছে সেই প্রাচীন কুলগাছের গুড়ি। গাছটিও জীবিত নেই। সেই গুড়িকে ঘিরেই নতুন ইটের মন্দির তৈরি হয়েছে। দুধ, চাল, কলা ইত্যাদি দিয়ে হাজারো ভক্ত মনসা মায়ের কাছে তাদের মনোবাঞ্ছা জানান। লোকবিশ্বাস অনুযায়ী, এই মেলার আরেকটি প্রধান অংশ হলো পাঠা বলি। আগে প্রচুর পাঠা বলি হলেও, এখন তা অনেক কমে এসেছে। তবে এখনও পাঠা বলি দেওয়া হয়।
🟢 মেলার চিত্রঃ মেলায় বসে অসংখ্য দোকান—খেলনা, গৃহস্থালির জিনিস, বাঁশ-বেতের সামগ্রী থেকে শুরু করে খাবারের আয়োজন।ভক্তরা মানতের ঢিল বাঁধেন, দণ্ডি কাটেন, মানতের পাঠা বলি দেন।হাজার হাজার মানুষ শুধু পূজা নয়, আনন্দে মেতে ওঠেন মেলার আবহে।
সম্প্রীতির উৎসবঃ এই মেলা শুধু ধর্মীয় উৎসব নয়, এটি এক সম্প্রীতির মিলনক্ষেত্র। শ্রাবণের সংক্রান্তিতে স্থানীয় হিন্দু-মুসলিম নির্বিশেষে সবাই অরন্ধন পালন করেন এবং মেলায় ভিড় জমান। এটি প্রমাণ করে ধর্মীয় ভেদাভেদ ছাপিয়ে এই মেলা একটি সামাজিক উৎসবে পরিণত হয়েছে।
মেলা ও কেনাকাটাঃ এখানে চাষের যন্ত্রপাতি, মাছ ধরার জাল, গৃহস্থালির জিনিসপত্র পাওয়া যায়। আমি নিজেও কিছু জিনিস কিনেছি—যেমন, রুটি বেলার বেলন, একটি টোকা বা মাথাল।
🟢 বর্তমান চ্যালেঞ্জঃ বন্যপ্রাণী সংরক্ষণ আইনের কারণে সাপুড়েদের সংখ্যা কমে যাচ্ছে। তবে ভক্তি, বিশ্বাস ও লোকসংস্কৃতির টানে আজও লক্ষাধিক মানুষের সমাবেশ ঘটে।
🟢 কীভাবে যাবেন?
শিয়ালদহ–রানাঘাট লাইনের চাকদহ স্টেশন থেকে বনগ্রামগামী যেকোনো বাস, ট্রেকার বা ভ্যানে সহজেই খেদাইতলার মেলায় পৌঁছানো যায়। চাকদহ-বিষ্ণুপুর বাজার থেকেও হেঁটে যাওয়া সম্ভব।
উপসংহারঃ সব মিলিয়ে, খেদাইতলার সাপের মেলা বাংলার প্রাচীন লোকসংস্কৃতির এক অনন্য প্রতিচ্ছবি। বিশ্বাস, ধর্ম, লোককথা আর আনন্দ এখানে একসঙ্গে মিশে এক অসাধারণ অভিজ্ঞতা তৈরি করে। প্রতি বছর হাজারো মানুষের সমাগম প্রমাণ করে যে এই ঐতিহ্য আজও সমানভাবে জীবন্ত।
We welcome thoughtful discussions. Comments are moderated for quality