রানাঘাট, নদিয়া জেলার একটি পরিচিত নাম। কিন্তু এই শহরটির পেছনে লুকিয়ে আছে এক জানা-অজানা ইতিহাস। অনেকে দাবি করেন, এর আদি নাম ছিল "ব্রহ্মদাঙ্গা", আবার কারো মতে, এই অঞ্চলের নামকরণ হয়েছে এক দুর্ধর্ষ ডাকাত 'রানা'-র নাম থেকে।আজকের এই পোস্টে আমরা রানাঘাটের নামকরণের ইতিহাস এবং এর সাথে জড়িয়ে থাকা এক বিখ্যাত জমিদার পরিবার, পালচৌধুরী পরিবারের কথা জানব।
রানাঘাটের নামকরণঃ রানা ডাকাত ও তিনটি গ্রাম।
ঐতিহাসিকদের মতে, ১৬৫০ থেকে ১৭২৮ সালের মধ্যে কৃষ্ণনগরের রাজা রঘুরামের শাসনকালে রানা নামে একজন কুখ্যাত ডাকাত এই অঞ্চলে তার ঘাঁটি গেড়েছিল। সেই সময় এই এলাকাটি ছিল নদী বেষ্টিত এবং জঙ্গলে ভরা। তাই দস্যুদের জন্য এটি ছিল এক আদর্শ আস্তানা। রানা দস্যুর সেই ঘাঁটি থেকেই "রানাঘাট" নামের উৎপত্তি।
উত্তরে জিয়ানগর, মধ্যে রানাঘাট ও দক্ষিণে নাসড়া — এই তিনটি গ্রাম নিয়ে রানাঘাট শহরটি গঠিত। রানাঘাটের অবস্থান বিশেষ রূপে পর্যালোচনা করলে দেখা যায়, এটি একসময় প্রায় চতুর্দিকে নদীবেষ্টিত ছিল। উত্তরে ছিল বাচকো নদী, দক্ষিণ ও পূর্বদিকে ছিল হাঙর নামা নদী, আর পশ্চিমে ছিল চূর্ণী নদী। এই নদীবেষ্টিত স্থানটিই দস্যু রানা'র ঘাঁটি হওয়ার পক্ষে সহায়ক ছিল।
১৭৭৪ সালে জেমস রেনলের আঁকা বাংলার মানচিত্রে রানাঘাটের নাম খুব ছোট করে দেখা যায়। তখন কৃষ্ণনগর, পলাশি, শান্তিপুরের মতো শহরগুলো অনেক বড় করে চিহ্নিত করা হয়েছিল। এতে বোঝা যায়, সেই সময়ে রানাঘাট ছিল একটি ছোট গ্রাম যা ধীরে ধীরে সমৃদ্ধি লাভ করছিল।
পালচৌধুরী পরিবারঃ এক গৌরবময় ইতিহাস।
রানাঘাটের সঙ্গে পালচৌধুরী পরিবারের নাম ওতপ্রোতভাবে জড়িত। এই পরিবারের উত্থান ও সমৃদ্ধি রানাঘাটকে নতুন পরিচয় এনে দেয়।
![]() |
রানাঘাটের পাল চৌধুরী জমিদার প্রাসাদ।(নির্মাণকাল প্রায় ১৭৮০-এর দশক) |
নির্মাণকাল প্রায় ১৭৮০-এর দশকঃ প্রায় আড়াই শতাব্দী পূর্বে কৃষ্ণ পান্তি (পাল) এই প্রাসাদটি নির্মাণ করেন।স্থানীয় ঐতিহাসিকদের তত্ত্ব থেকে জানা যায়, স্কটল্যান্ডের স্থপতিদের সহযোগিতায় তিনি তাঁর উত্তরপুরুষদের জন্য ৩০০-টিরও অধিক কক্ষবিশিষ্ট এই বিশাল ভবনটি গড়ে তোলেন।“চৌধুরী” উপাধি প্রদান করেছিলেন কৃষ্ণনগরের মহারাজা কৃষ্ণচন্দ্র। এটি ছিল শম্ভু পালচৌধুরী ও তাঁদের উত্তরসূরিদের আবাসস্থল।ছবিটি তোলা হয়েছিল ১৯৩৮ সালে ইংল্যান্ডের রাজা ষষ্ঠ জর্জের অভিষেক উপলক্ষে।
কৃষ্ণচন্দ্র পালচৌধুরীঃ এক দরিদ্র থেকে ধনী ।
১১৫৬ বঙ্গাব্দে রানাঘাটে এক দরিদ্র পরিবারে জন্ম হয়েছিল কৃষ্ণপান্তি। তাহার পিতা সহস্ররাম পান্তি কায়ক্লেশে সংসার যাত্রা নির্বাহ করিতেন।সহস্ররাম পান্তির তিন পুত্র ছিল। প্রথম কৃষ্ণচন্দ্র, দ্বিতীয় শম্ভুচন্দ্র ও তৃতীয় নিধিরাম।
কৃষ্ণ ও শম্ভু ছোটবেলা থেকেই খুব বুদ্ধিমান ছিলেন। অন্যদিকে, নিধিরাম গুরুতর অসুস্থ থাকায় কোনো কাজেই পারদর্শী ছিলেন না। কথিত আছে, কৃষ্ণচন্দ্রের বাবা মারা গেলে তার হাতে ছিল মাত্র আধুলি টাকা। সেই টাকা নিয়েই তিনি ব্যবসা শুরু করেন। নিজের পরিশ্রম ও ভাগ্যের জোরে তিনি প্রচুর সম্পদ অর্জন করে বাংলার অন্যতম ধনী হন। এই ব্যবসা থেকে পাওয়া লাভ দিয়ে তাঁর মেজ ভাই শম্ভুচন্দ্র জমিদারি কিনতে শুরু করেন। তাঁদের প্রথম জমিদারি ছিল সাঁতোর পরগণায়। তার এই সাফল্যের কারণে নদিয়ারাজ শিবচন্দ্র, কৃষ্ণপান্তিকে "চৌধুরী" উপাধি দেন।
কিছুদিন পর বাংলার গভর্নর জেনারেল মারকুইস হেস্টিংস (1813 থেকে 1823 সাল পর্যন্ত) সাহেব মফস্বল ভ্রমণে এসে রানাঘাটে পৌঁছান। কৃষ্ণচন্দ্রের ধন-সম্পদ ও তার আতিথেয়তায় মুগ্ধ হন এবং তাকে "রাজা" উপাধি দিতে চান। কিন্তু কৃষ্ণচন্দ্র পাল চৌধুরী তাঁর স্বাভাবিক সরলতা ও বিনয়ের কারণে সেই উপাধি সসম্মানে প্রত্যাখ্যান করেন। নদিয়াধিপতির ‘চৌধুরী’ উপাধি তাঁকে প্রদান করেন, যা ইন্ডিয়া গভর্নমেন্টের অনুমোদনপ্রাপ্ত হয়। লর্ড হেস্টিংস তাঁর এই সরল ও ভদ্র ব্যবহারে অত্যন্ত আনন্দিত হয়ে তাঁর সঙ্গে গভীর বন্ধুত্ব স্থাপন করেন।
কৃষ্ণচন্দ্র পালচৌধুরী শুধু ধনীই ছিলেন না, একজন দানশীল ব্যক্তিও ছিলেন। তার কিছু উল্লেখযোগ্য কাজ- মান্দ্রাজ দুর্ভিক্ষে লক্ষ মন চাল দান।অনেক বড় বড় পুকুর খনন। গঙ্গাস্নানে যাওয়ার জন্য রানাঘাট থেকে জগপুর পর্যন্ত একটি দীর্ঘ রাস্তা তৈরি।
![]() |
রানাঘাটের ঐতিহাসিক জমিদার বাড়ির প্রবেশদ্বার। |
পারিবারিক বিবাদ ও জমিদারির পতনঃ
কৃষ্ণচন্দ্রের মেঝো ভাইয়ের প্ররোচনায়, মৃত্যুর আগে তাঁর সমস্ত সম্পত্তি এভাবে ভাগ করে যান—তিনি ও তাঁর মধ্যম ভাই শম্ভুচন্দ্র পেয়েছিলেন সমগ্র সম্পত্তির মূল অংশ, আর ছোট ভাই নিধিরাম, যিনি অসুস্থ ও কর্মক্ষম ছিলেন না, পেয়েছিলেন বছরে মাত্র ১২ হাজার টাকার আয়ের সম্পত্তি এবং নগদ ৪ লক্ষ টাকা। এই অসম ভাগাভাগিই কৃষ্ণচন্দ্রের মৃত্যুর পর পালচৌধুরী এস্টেটের সর্বনাশ ডেকে আনে।
এই কঠিন সময়ে, শম্ভুর বংশে জন্ম নেন জয়গোপাল বাবু। তিনি এস্টেটের ব্যবস্থাপনা ঠিকঠাক করার আগেই দুর্ভাগ্যবশত ১২৫৬ সালে মাত্র ২৬ বছর বয়সে মারা যান, রেখে যান একমাত্র কন্যা। জয়গোপালের মৃত্যুর পর তাঁর যোগ্য ভাই শ্রীগোপাল পালচৌধুরী এস্টেটের দায়িত্ব নেন। ১২৭৮ সালে তাঁর মৃত্যু হলে তাঁর স্থলাভিষিক্ত হন পুত্র সুরেন্দ্রনাথ। উপরের মহান ব্যক্তিদের ছাড়াও, পালচৌধুরী পরিবারে আরও অনেক খ্যাতিমান ব্যক্তি জন্মেছেন। তাঁদের মধ্যে শম্ভুর পৌত্র বাবু জয়চাঁদ পালচৌধুরীর নাম বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য।
প্রজাহিতৈষী বঙ্গেশ্বর গ্রান্ট মহাশয় নীল কমিশনে তাঁর সাক্ষ্যের ওপর বিশেষ আস্থা রেখেছিলেন। কথিত আছে, তাঁর মতো উদার মনের ‘বাবু’ তৎকালীন সমগ্র বাংলায় দ্বিতীয় কেউ ছিলেন না। তবে তাঁর ভালো সুনামের পাশাপাশি, তিনি একজন অত্যাচারী জমিদার হিসেবেও কুখ্যাত ছিলেন। তখনকার দিনে কারও প্রতি বিরূপতা প্রকাশ করতে মানুষ বলত— “তোকে জয়চাঁদে পাক”।
![]() |
পাল চৌধুরী বাড়ির ধ্বংসাবশেষ। |
উপসংহারঃ রানাঘাটের ইতিহাস কেবল একটি স্থানের নয়, এটি রানা নামক এক ডাকাতের থেকে শুরু করে কৃষ্ণচন্দ্র পালচৌধুরীর মতো একজন সফল মানুষের উত্থানের গল্প। এটি পরিবারের গৌরব, পতন এবং পুনরায় সম্মান পুনরুদ্ধারের এক অসাধারণ আখ্যান। রানাঘাটের মাটি আজও তার প্রাচীন ইতিহাস ও সংস্কৃতির সাক্ষ্য বহন করে চলেছে।
We welcome thoughtful discussions. Comments are moderated for quality