![]() |
১৯৪৯ সালের রানাঘাটের উন্মুক্ত শরণার্থী শিবিরের একটি বিরল দৃশ্য |
স্বাধীনতা ভারতে এসেছিল ঠিকই, কিন্তু বাঙালি জাতিকে পঙ্গু করে, হিংসার বলি বানিয়ে কেবলমাত্র আনুষ্ঠানিকভাবে ক্ষমতা হস্তান্তর করা হয়েছিল। ব্রিটিশরা প্রকৃতপক্ষে একদম নিরপেক্ষ ভাব দেখিয়েছিল, কিন্তু পর্দার আড়ালে, তারা দেশ-ক্ষমতালোভী নেতাদের সঙ্গে মিলে হিন্দুদের বিরুদ্ধে মুসলিমদের উসকে দিয়ে, পরিস্থিতিকে আরও ভয়াবহ করে তুলেছিল।সহিংসতা, সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা এবং নিরাপত্তাহীনতার কারণে মানুষ গৃহহীন হয়ে পড়ে।
দেশভাগে (১৯৪৭) মুসলমানের তুলনায় হিন্দুরাই বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছিল, এই বিষয়ে কোনো সন্দেহ নেই।দেশ বিনিময়ের সময় সম্ভ্রান্ত হিন্দু পরিবার বিভিন্ন মধ্যস্থতাকারীর সাহায্যে সম্পত্তি বিনিময় করেছিল।
বিনিময়ের প্রথাটি ছিল ৩:১ অনুপাতে বা কোথায় কোথায়, ৩:২ অনুপাতে সম্পত্তি হস্তান্তর।—যেমন, পূর্ব পাকিস্তান থেকে ৩ বিঘা জমি হারানো হিন্দু এই পারে মাত্র ১ বিঘা মুসলমান সম্পত্তি পেতেন।
আবার পূর্ব পাকিস্তানে যারা অর্থনৈতিকভাবে দুর্বল ছিলেন, তারা এই বিনিময় প্রথায় একেবারেই অংশ নিতে পারেননি। ফলে তারা ভিটেমাটি ছেড়ে রাতারাতি পালিয়ে এসেছিলেন ভারতের-যুক্ত-বঙ্গে।
তাদের আশ্রয় হয়েছিল উদ্বাস্তু শিবিরে। অনেকেই আত্মীয় হারিয়ে, এমনকি স্ত্রী-সন্তান হারিয়ে ফেলেছিলেন, এই পারে পাড়ি দিতে গিয়ে। সেইসমই পূর্ব পাকিস্তানের বর্বর মুসলিমদের অত্যাচার—সে যেন ছিল নরকের প্রতিচ্ছবি। অন্তত বৃদ্ধ ঠাকুমা-দাদুদের স্মৃতি থেকে যা শোনা যায়। সত্যি বলতে, নিজের ধর্ম ও পরিবারের মা-বোনদের সম্মান রক্ষা করার জন্য ভিটেমাটি ছেড়ে উদ্বাস্তু শিবিরের শরণ নিতে হয়েছিল অসংখ্য মানুষকে।
ভারত-পাকিস্তান সীমান্তের ১৩৫০ মাইল জুড়ে সেই সময় গড়ে উঠেছিল অসংখ্য শরণার্থী শিবির। সেই সব শিবিরের মধ্যে পশ্চিমবঙ্গের নদিয়া জেলার রানাঘাট, কুপার্স ক্যাম্প, ধুবুলিয়াসহ বিভিন্ন অঞ্চলে আশ্রয় নিয়েছিলেন।রানাঘাট এবং কুপার্স ক্যাম্প ছিল অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ দুটি নাম।
রানাঘাটের চূর্ণী নদীর তীরে অবস্থিত এই অঞ্চলটি তাই শরণার্থীদের প্রধান গন্তব্য হয়ে ওঠে। তবে এসব ক্যাম্পে জীবন সহজ ছিল না। ঘিঞ্জি ও অস্বাস্থ্যকর পরিবেশে।যেখানে স্বাস্থ্যঝুঁকি ছিল মারাত্মক। তবু, এর মাঝেই মানুষ নিজেদের জীবনকে নতুন করে গুছিয়ে নেওয়ার লড়াই চালিয়ে গেছে।এটি শুধু একটি ট্রানজিট ক্যাম্প ছিল না, এটি হয়ে উঠেছিল পশ্চিমবঙ্গ জুড়ে শরণার্থী পুনর্বাসন আন্দোলনের এক কেন্দ্রবিন্দু।রানাঘাটের আশেপাশের বিভিন্ন অঞ্চলে, রানাঘাট শহরের প্রায় ৮৭% পরিবার এবং কুপার্স ক্যাম্পের ৯৯.৯৯% পরিবার আজও সেই সাক্ষী বহন করছে।
এই ক্যাম্প-ব্যবস্থা থেকে মুক্ত হয়ে স্বনির্ভরভাবে বাঁচার জন্য ১৯৭১ সালের জয়বাংলার সারানাথইদের, এবং এর সাথে উদ্বাস্তুদের, পাট্টা হিসেবে প্রায় ৩ শতক, ৫ শতক বা ৮ শতক করে জমি প্রদান করেছিল রিলিফ অফিস। সরকার জমির পাট্টা দিয়ে বসত বসানোর পাশাপাশি গৃহনির্মাণের জন্যও সাহায্য করেছিল। এছাড়া, টিবি রোগীদের প্রায় ৯ বিঘা হালচাষযোগ্য জমিও দেওয়া হয়েছিল।
এছাড়াও ‘ডোল’ বা রেশন ব্যবস্থা চালু ছিল। তবে সময়ের সাথে সাথে এই ডোল ব্যবস্থা কমতে শুরু করে। কুপার্স ক্যাম্পে ২০১১ ও ২০১২ সাল পর্যন্ত এই ডোল চালু ছিল, তবে বর্তমানে সম্ভবত আর নেই।
এই ‘ডোল’ বলতে —প্রতিদিন ৩ বেলার ভরপেট খাবার, আড্ডা বা তাস খেলার জন্য তাস বা অন্যান্য সরঞ্জাম, নেশাদ্রব্য যেমন তামাক-বিড়ি, এবং তার খরচের জন্য মাথাপিছু নগদ ভাতা। অর্থাৎ, সম্পূর্ণ ভরণপোষণের ব্যবস্থা ছিল।
We welcome thoughtful discussions. Comments are moderated for quality