ব্যারাকপুরের অন্নপূর্ণা মন্দির: দক্ষিণেশ্বরের প্রতিচ্ছবি এক অসাধারণ তীর্থস্থান !

ব্যারাকপুরের অন্নপূর্ণা মন্দির: দক্ষিণেশ্বরের প্রতিচ্ছবি এক অসাধারণ তীর্থস্থান !

লালপেঁচা.in – বাংলার না-বলা কথা
0

 কলকাতার উত্তর প্রান্তে টিটাগড়ে (ব্যারাকপুর) তালপুকুরে, গঙ্গার পূর্বতীরে দাঁড়িয়ে আছে দক্ষিণেশ্বর কালীমন্দিরের স্থাপত্যরূপে নির্মিত শিবশক্তি অন্নপূর্ণা মন্দির। প্রচলিত নাম শ্রীশ্রী অন্নপূর্ণা ঠাকুরানীর নবরত্ন মন্দির। এখানে ইতিহাস, ঐতিহ্য এবং ভক্তির এক অপূর্ব সংমিশ্রণ দেখা যায়। গঙ্গাতীরে মন্দিরটি গড়ে তোলার পর, সেটি ১৮৭৫ সালের ১২ই এপ্রিল (১২৮১ বঙ্গাব্দের ৩০শে চৈত্র) তারিখে ভক্তদের জন্য উন্মুক্ত করা হয়, শ্রীরামকৃষ্ণ পরমহংসদেবের দ্বারা। 

প্রতিষ্ঠার কাহিনিঃ 

এই মন্দিরের প্রতিষ্ঠাত্রী ছিলেন রানি রাসমণির কনিষ্ঠা কন্যা জগদম্বা দেবী। তাঁর স্বামী মথুরামোহন বিশ্বাস করুণাময়ী দেবীর ( রানি রাসমণির দ্বিতীয় কন্যা ) মৃত্যুর পর জগদম্বাকে বিবাহ করেছিলেন।

মথুরবাবুর ইচ্ছা ও জগদম্বার অদম্য আগ্রহেই এই মন্দিরের প্রতিষ্ঠা হয়। মন্দিরটির নির্মাণকাজ তদারকি করেছিলেন মথুরমোহন বিশ্বাস এবং তাদের পুত্র দ্বারিকানাথ বিশ্বাস।

শ্রীরামকৃষ্ণ পরমহংসদেব নিজে উপস্থিত থেকে মন্দিরের উদ্বোধন করেন। এটি ছিল এক যুগান্তকারী ঘটনা—দক্ষিণেশ্বরের পর মা অন্নপূর্ণার আশীর্বাদে আরেকটি নবরত্ন মন্দির প্রতিষ্ঠা।এই মন্দির, আজও ভক্তদের কাছে এক মহৎ তীর্থক্ষেত্র। 

স্থাপত্যরূপ ও মন্দিরের বর্ণনা: 

মৌখিক ইতিহাস থেকে জানা যায়, শিবশক্তি অন্নপূর্ণা  এই স্থাপত্য নির্মাণে প্রায় পাঁচ বছর সময় লেগেছিল। দক্ষিণেশ্বরের স্থপতিরাই এই কাজের সঙ্গে যুক্ত ছিলেন। এখানেও স্থাপত্যের মূল অংশে পদ্মকার্য যুক্ত ছিল। এতে রয়েছে—একটি নবরত্ন স্থাপত্যশৈলী, নাটমন্দির, দুটি নবস্তবখানা, ছয়টি আটচালা শিবমন্দির, ভোগের ঘর এবং প্রাচীরঘাট (রাসমণি ঘাট)। 

শিবশক্তি অন্নপূর্ণা মন্দিরে রত্নের মাথায় রয়েছে চক্র। এটি দক্ষিণেশ্বর কালীমন্দিরের প্রতিরূপ হলেও কিছু পার্থক্য লক্ষ্য করা যায়।

 দক্ষিণেশ্বর কালী মন্দিরে যেখানে ১২টি শিবমন্দির আছে, এখানে রয়েছে ৬টি শিবমন্দির।প্রতিটি কালো পাথরের শিবলিঙ্গে অলঙ্কৃত।

ছয়টি শিবমন্দির: মন্দিরের পশ্চিম দিকে উত্তর-দক্ষিণে সারিবদ্ধভাবে তিনটি করে মোট ছয়টি আটচালা শিবমন্দির রয়েছে। ধ্যানঘরের পাশ থেকে ক্রমানুসারে-কল্যাণেশ্বর, কাশীশ্বর, কিরণেশ্বর। এরপর গঙ্গার ঘাটে যাওয়ার পথ, তার পর আবার মন্দিরের সারি- কেদারেশ্বর, কৈলাশেশ্বর এবং  কপিলেশ্বর। প্রতিটি মন্দিরেই  প্রায় তিন ফুট উচ্চ একটি করে কালো রঙের পাথরের শিবলিঙ্গ প্রতিষ্ঠিত আছে।

মূল শিবশক্তি অন্নপূর্ণা মন্দিরঃ গর্ভগৃহের ভেতরে শ্বেতপাথরের বেদির উপর রৌপ্যসিংহাসনে দেবী অন্নপূর্ণা ও মহাদেব শিবের বিগ্রহ । অষ্টধাতুর মা অন্নপূর্ণা—ডান হাতে অন্নদান করার ভঙ্গি, বাঁ হাতে অন্নপাত্র। দেবীর ডান পাশে মহাদেব শিব দণ্ডায়মান ( রৌপ্যমূর্তি )।

নাটমন্দির: মূল মন্দিরের সামনে একটি প্রশস্ত নাটমন্দির রয়েছে, যা তার কারুকার্য এবং খিলান , উঁচু থামের জন্য বিশেষ আকর্ষণীয়। এবং দুটি নহবতখানা (সঙ্গীত আসর বসানোর জায়গা)। 

মন্দিরের প্রবেশদ্বারে রয়েছে একটি বিশাল সিংহদুয়ার, যার ওপর একটি সিংহের মূর্তি যেন এই মন্দিরকে ব্রিটিশ আমল থেকে পাহারা দিয়ে আসছে। 

সিংহমূর্তি ও আইনি ইতিহাস

ব্রিটিশ সরকার একসময় এটি সরানোর চেষ্টা করেছিল—কারণ তাদের মতে সিংহ সাম্রাজ্যের প্রতীক। মন্দির কর্তৃপক্ষ মামলা লড়ে কোর্ট থেকে রায় আনে—“Art is art, let the art prevail.” আজও সেই সিংহমূর্তি এই মন্দিরের ইতিহাসের সাক্ষী।

 

এই মন্দির নির্মাণের সাথে গভীরভাবে জড়িত ছিলেন রানি রাসমণির কনিষ্ঠ কন্যা জগতদম্বা দেবী। তাঁর উদ্যোগেই অন্নপূর্ণা মন্দির গড়ে ওঠে। তবে শুধু নির্মাণ নয়, এই ভূমি আরও পবিত্র হয়ে ওঠে কারণ শ্রীশ্রী রামকৃষ্ণ পরমহংসদেব একাধিকবার এখানে পদার্পণ করেছিলেন। তিনি নানা সময়ে বিভিন্ন কারণে এখানে আসতেন এবং তাঁর সেই উপস্থিতি আজও ভক্তদের কাছে এক বিশেষ আধ্যাত্মিক তাৎপর্য বহন করে।

শ্রীশ্রী রামকৃষ্ণদেব চারবার এই মন্দিরে পদার্পণ করেছিলেন—
১. জমি ক্রয়ের সময় স্থান নির্বাচন করতে,
২. ভিত স্থাপনের সময়ে,
৩. ১৮৭৫ সালে উদ্বোধনের দিনে,
৪. ১৮৮২ সালে উল্টোরথ উপলক্ষে।

এতে প্রমাণিত হয়, এই মন্দির তাঁর কাছে কতখানি তাৎপর্যপূর্ণ ছিল।

 মন্দির দর্শন:

  • গ্রীষ্মকাল: সকাল ৫.৩০–দুপুর ১২.৩০ ও বিকেল ৪টা–রাত ৮টা।

  • শীতকাল: সকাল ৬টা–দুপুর ১টা ও বিকেল ৩.৩০–রাত ৮টা।

প্রতিদিন ভোরে মঙ্গল আরতির পর পূজা অনুষ্ঠিত হয়। সকাল ৮টা থেকে ১১টা পর্যন্ত ভক্তরা পূজা দিতে পারেন। দুপুরে হয় অন্নভোগ।শিবশক্তি অন্নপূর্ণা মন্দিরে ভোগ গ্রহণের জন্য ভক্তদের আগে থেকে কুপন কেটে নিতে হয়। প্রতিজনের জন্য কুপনের মূল্য ₹১২০, যা দুপুর ১২টা ৩০ মিনিটের মধ্যে সংগ্রহ করতে হয়।

শিবশক্তি অন্নপূর্ণা মন্দিরে দুপুর ১টায় আরতি হয়। আরতির পর প্রতিদিন দুপুরে মায়ের ভোগ নিবেদন করা হয়। ভোগ নিবেদন শেষ হলে মন্দিরের গৃহ বন্ধ করে দেওয়া হয়।এরপর, ভক্তদের অন্ন পরিবেশন করা হয়।এই ভোগ শুধুমাত্র নিরামিষ খাবার।সাধারণত, দুপুর ১:৩০ টা থেকে অন্ন পরিবেশন করা হয়।ভোগে সাধারণত পরিবেশন করা হয় - এক চামচ বসন্তী পোলাও, ভাত, ডাল ,ভাজি, বাঁধাকপি ও সয়াবিনের দুটি তরকারি, চাটনি,পাপড়,পায়েস।

তবে বেশ কিছু ভক্তের দাবি, ভোগের গুণমানের তুলনায় মূল্য অনেকটাই বেশি।একটি সাধারণ দিনে, বিশেষ কোনো পূজার দিন ছাড়া প্রায় ২০ থেকে ৩০ জন ভক্ত কুপনের মাধ্যমে ভোগ সংগ্রহ করেন। আর বিশেষ অনুষ্ঠানের দিনে প্রচুর ভক্ত কুপন সংগ্রহ করেন।

এর পর আবার বিকেলে মন্দির খোলে।সন্ধ্যায় অনুষ্ঠিত হয় আরতি ও শীতলপুজো।প্রতিবছর দুর্গাপূজার অষ্টমী তিথিতে দেবী অন্নপূর্ণার পূজা মহাধুমধামে পালিত হয়। সেদিন বিশেষ পূজার পাশাপাশি হোম-যজ্ঞও অনুষ্ঠিত হয়। স্থানীয়ভাবে অনেকেই মন্দিরটিকে “রানী রাসমণি মন্দির” নামেও চেনেন।

কীভাবে পৌঁছাবেনঃ শিবশক্তি অন্নপূর্ণা মন্দিরের ঠিকানা- পার্ক রোড, ব্যারাকপুর, তালপুকুর, উত্তর ২৪ পরগনা ।📞 অফিসিয়াল নাম্বার (পূজা ও ভোগ সংক্রান্ত যোগাযোগ): 03325010203

রেলপথেঃ ব্যারাকপুর স্টেশন নেমে লোকাল পরিবহন বা অটোতে সহজেই পৌঁছানো যায়।
সড়কপথেঃ কলকাতা থেকে গাড়িতে ঘন্টাখানেক সময় লাগে।

যদিও অন্নপূর্ণা মন্দিরটি উত্তর ২৪ পরগনার টিটাগড়ে অবস্থিত, তবুও যাতায়াতের জন্য ব্যারাকপুর থেকেই সবচেয়ে সুবিধাজনক পথ

আপনি চাইলে—ব্যারাকপুর স্টেশন থেকে অটো রিজার্ভ করে সরাসরি মন্দিরে যেতে পারেন ( রিজার্ভ ভাড়া প্রায় ১০০ টাকা )।

অথবা ব্যারাকপুর থেকে গান্ধীঘাট পর্যন্ত অটো/টোটো (ভাড়া প্রায় ১৫ টাকা) নিয়ে সেখান থেকে হেঁটেও মন্দিরে পৌঁছানো যায়।
মন্দিরে প্রবেশের আগে মূল গেটে একজন রক্ষী থাকেন। তিনি একটি লগবুকে আপনার নাম, ফোন নম্বর এবং কোথা থেকে এসেছেন তা লিখতে বলবেন নিরাপত্তার কারণে।

 

মন্দির প্রাঙ্গণে প্রবেশের পর মনে অদ্ভুত এক শান্তির আবেশ নেমে আসে। তবে সাবধান থাকতে হবে—নাটমন্দির প্রাঙ্গণে প্রচুর পায়রা বিচরণ করে, ফলে উপর থেকে পায়রার মল বা ময়লা পড়ে যাওয়ার সম্ভাবনা থাকে। তাই ভক্তদের জন্য পরামর্শ, চারপাশ দেখে নিয়ে তারপর শান্তিতে বসুন নাটমন্দিরের
✍️ ভ্রমণকারীদের জন্য তালপুকুর অন্নপূর্ণা মন্দির শুধু ধর্মীয় নয়, এক ঐতিহ্য ও সংস্কৃতির পরিচায়ক।

🔴 ভালো লাগলে 👉 ফেসবুকে Raju Biswas পেজটি Follow করুন।
🟠 আমাদের ব্লগ 👉 Lalpecha.in
🟢 আর আমাদের YouTube চ্যানেল 👉 Lalpecha Subscribe করুন।

কোনো প্রশ্ন থাকলে নির্দ্বিধায় কমেন্ট করুন। 💬❓

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

0মন্তব্যসমূহ

We welcome thoughtful discussions. Comments are moderated for quality

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন (0)

#buttons=(Ok, Go it!) #days=(20)

Our website uses cookies to enhance your experience. Check Now
Ok, Go it!