বিলুপ্তপ্রায় এক ঐতিহ্য: জঙ্গলমহলের প্রাকৃতিক বর্ষাতি 'ঘঙ'

বিলুপ্তপ্রায় এক ঐতিহ্য: জঙ্গলমহলের প্রাকৃতিক বর্ষাতি 'ঘঙ'

লালপেঁচা.in – বাংলার না-বলা কথা
0

বিলুপ্তপ্রায় এক ঐতিহ্য: জঙ্গলমহলের প্রাকৃতিক বর্ষাতি 'ঘঙ'

 


বিলুপ্তপ্রায় এক ঐতিহ্য: জঙ্গলমহলের প্রাকৃতিক বর্ষাতি 'ঘঙ'

বৃষ্টি মানেই ছাতা বা রেনকোট – আমাদের শহুরে জীবনে এটাই চেনা ছবি। কিন্তু পশ্চিমবঙ্গের জঙ্গলমহলের গভীরে লুকিয়ে আছে এক অন্য গল্প, এক অসাধারণ লোকশিল্পের নিদর্শন যা প্রকৃতির সঙ্গে মানুষের সহাবস্থানের এক অনন্য উদাহরণ। সেই গল্প হলো 'ঘঙ'-এর গল্প, প্রান্তিক মানুষের হাতের জাদুতে তৈরি এক প্রাকৃতিক বর্ষাতি যা একসময় ছিল তাঁদের বর্ষাকালের প্রধান ভরসা।


'ঘঙ' কী এবং এটি কীভাবে তৈরি হয়?

ঘঙ (বা ঘোঙ) হল এক প্রকার পিরামিড আকৃতির পাতার তৈরি ছাউনি যা মাথায় চাপিয়ে রাখা হয়। এটি মাথা থেকে পিঠ এবং হাঁটু পর্যন্ত শরীর ঢেকে রাখে, ফলে বর্ষার মাঝেও কৃষিকাজ নির্বিঘ্নে করা সম্ভব হয়। 'ঘঙ' তৈরি হয় চিহড় (Chihur) নামের একপ্রকার লতাপাতা দিয়ে, যা জঙ্গলমহলের শালবনে শালগাছ বেয়ে ওঠে। এর খাঁজকাটা পাতা দিয়েই তৈরি হয় এই বিশেষ বর্ষাতি।

এই বর্ষাতি তৈরির প্রক্রিয়াটি বেশ সময়সাপেক্ষ এবং ধৈর্যের কাজ:

  • পাতা সংগ্রহ ও শুকানো: প্রতি বছর গ্রীষ্মকালে, বিশেষত চৈত্র-বৈশাখ মাসে চিহড় পাতা সংগ্রহ করা হয়। এই সবুজ পাতাগুলো রোদে শুকোতে দেওয়া হয়, যা ধীরে ধীরে তামাটে রঙ ধারণ করে।
  • বুননের প্রস্তুতি: জ্যৈষ্ঠ মাসের শেষে বা আষাঢ়ের শুরুতে, যখন বাতাসে আর্দ্রতা আসে এবং পাতাগুলো কিছুটা নরম হয়, তখনই শুরু হয় 'ঘঙ' তৈরির কাজ।
  • হাতের কারুকার্য: জঙ্গলমহলের মেয়ে-বউরা, বিশেষত মহালী জনগোষ্ঠী, সজারুর কাঁটাকে দু'দিকে ছুঁচলো করে তা দিয়েই এই পাতাগুলো সেলাই করে। এই দক্ষতা বহু যুগের অভ্যাসে অর্জিত, যা আধুনিক যন্ত্রপাতির যুগেও দুর্লভ।
  • গঠন ও সেলাই: একটি পাতার নিচে দুটি পাতা, তারপর তার নিচে তিন-চারটি পাতা – এই ক্রমে পাতাগুলো সেলাই করা হয়, যেন মাছের আঁশের মতো উপর থেকে নিচে সারি সারিভাবে সাজানো। সামনের দিক খোলা রেখে এটি একটি পিরামিড আকৃতির রূপ নেয়। প্রয়োজন অনুযায়ী বাচ্চাদের জন্য ছোট এবং প্রাপ্তবয়স্কদের জন্য বড় 'ঘঙ' তৈরি করা হয়।
  • সমাপ্তি: একটি 'ঘঙ' তৈরি করতে কয়েকদিন সময় লাগে। সকালে বাড়ির মেয়ে বা বউরা শুরু করেন, দুপুরে গৃহিণী তাঁর কাজ সেরে আবার এটি নিয়ে বসেন। এভাবেই ধীরে ধীরে একটি 'ঘঙ' পূর্ণতা পায়।

'ঘঙ'-এর ব্যবহার ও গুরুত্ব

জঙ্গলমহলের চাষী এবং আদিবাসী জনগোষ্ঠীর কাছে 'ঘঙ' ছিল বর্ষাকালের এক অবিচ্ছেদ্য অংশ। এটি শুধুমাত্র বৃষ্টি থেকে বাঁচাতো না, বরং তাঁদের দৈনন্দিন কৃষি কাজ চালিয়ে যেতে সাহায্য করতো।

  • কৃষি কাজ ও সুরক্ষা: বর্ষাকালে মাথায় 'ঘঙ' চাপিয়ে চাষীরা অনায়াসে মাঠে মই দেওয়া, বীজ বোনা, এমনকি ফসল তোলার কাজও করতে পারতেন। এটি মাথা থেকে শরীরের পিছনের অংশ পর্যন্ত ঢেকে রাখতো, ফলে বৃষ্টির ঝাপটা থেকে রক্ষা পাওয়া যেত। রোদ, প্রবল বৃষ্টি বা শিলাবৃষ্টিতেও 'ঘঙ' দারুণ কার্যকরী ছিল।
  • পরিবেশ-বান্ধব: এটি সম্পূর্ণ প্রাকৃতিক এবং পরিবেশ-বান্ধব একটি উপকরণ। সিন্থেটিক বর্ষাতির মতো পরিবেশের উপর এর কোনো নেতিবাচক প্রভাব নেই।
  • ওজন: যদিও 'ঘঙ' খুবই কার্যকরী ছিল, এর প্রধান অসুবিধা ছিল এর ওজন। একটি পূর্ণাঙ্গ 'ঘঙ' প্রায় তিন থেকে পাঁচ কিলোগ্রাম বা তারও বেশি ভারী হতে পারতো, যা মাথায় চাপিয়ে ঘোরা সহজ ছিল না।

কোথায় কোথায় ব্যবহৃত হয় 'ঘঙ'?

'ঘঙ' মূলত ব্যবহৃত হয় পশ্চিমবঙ্গের জঙ্গলমহলের জেলাগুলিতে:

  • পুরুলিয়া
  • বাঁকুড়া
  • ঝাড়গ্রাম
  • পশ্চিম মেদিনীপুর

এই এলাকার আদিবাসী ও চাষীরা বর্ষাকালে চাষের সময় এই 'ঘঙ' ব্যবহার করেন।


বর্তমান পরিস্থিতি এবং বিলুপ্তির পথে 'ঘঙ'

আধুনিকতার ছোঁয়ায় এবং প্লাস্টিকের বর্ষাতির সহজলভ্যতার কারণে 'ঘঙ' শিল্প আজ বিলুপ্তির পথে।

  • কৃত্রিম বর্ষাতির আগমন: বর্তমানে প্লাস্টিকের বা সিন্থেটিক উপাদানের তৈরি বর্ষাতিগুলো ওজনে অনেক হালকা এবং দামে সস্তা। এগুলো তৈরি করার কোনো ঝক্কিও নেই। ফলে, চাষীরা ক্রমশ প্রাকৃতিক 'ঘঙ'-এর পরিবর্তে হালকা ও সহজলভ্য বিকল্পের দিকে ঝুঁকছেন।
  • সরকারি সহায়তা: বিভিন্ন স্বেচ্ছাসেবী সংগঠন এবং সরকারি উদ্যোগে এখন চাষীদের মধ্যে কৃত্রিম বর্ষাতি বিতরণ করা হয়, যা 'ঘঙ'-এর ব্যবহারকে আরও কমিয়ে দিয়েছে।
  • হারিয়ে যাওয়া ঐতিহ্য: 'ঘঙ' শুধুমাত্র একটি বর্ষাতি ছিল না, এটি ছিল জঙ্গলমহলের মানুষের জীবনযাত্রার, লোকশিল্পের এবং প্রকৃতির সঙ্গে তাঁদের গভীর সম্পর্কের এক প্রতিচ্ছবি। এই হস্তশিল্পের বিলুপ্তি মানে একটি অনন্য সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যের হারিয়ে যাওয়া।

তবুও, এখনো জঙ্গলমহলের কিছু প্রত্যন্ত অঞ্চলে, বিশেষত মহালী জনবসতিতে, 'ঘঙ'-এর অস্তিত্ব খুঁজে পাওয়া যায়। ঝাড়গ্রামের চিল্কিগড়ের কাছে অবস্থিত 'বড়ো ঘঙ' ও 'ছোটো ঘঙ' গ্রাম দুটি এখনো মহালী জনজাতির 'ঘঙ' তৈরির ঐতিহ্য বহন করে। এমনকি সাঁওতালদের ছাতা পরবেও চিহড় পাতার ছাতার ব্যবহার তাদের ধর্মীয় জীবনে এর গুরুত্ব তুলে ধরে।


ইতিহাস ও সংস্কৃতি: লোকজ জীবনধারায় 'ঘঙ'

'ঘঙ' কেবলমাত্র একটি বস্তু নয়, এটি জঙ্গলমহলের প্রান্তিক সমাজের হস্তশিল্প, লোকশিল্প ও আধ্যাত্মিক বিশ্বাসের মিশেল।

  • সাঁওতাল সম্প্রদায়ের ধর্মীয় উৎসবে চিহড় পাতার ছাতা উৎসর্গ করা হয়।
  • মহালী জনগোষ্ঠীর গ্রামগুলির নামই "বড়ো ঘঙ" ও "ছোটো ঘঙ", যা এ শিল্পের গুরুত্ব প্রমাণ করে।
  • বিরহোড় সম্প্রদায় বুনো চিহড় লতা দিয়ে ‘কুম্ভা’ নামক বাসস্থান নির্মাণ করে।

'ঘঙ' বনাম আধুনিক রেনকোট

বিষয় ঘঙ আধুনিক রেনকোট
উপাদান চিহড় পাতা (প্রাকৃতিক) সিন্থেটিক/প্লাস্টিক
ওজন ৩-৫ কেজি ২০০-৩০০ গ্রাম
পরিবেশ বান্ধব
তৈরির সময় কয়েকদিন কারখানায় উৎপাদিত
টেকসই

কেন সংরক্ষণ জরুরি?

  • এটি পরিবেশবান্ধব এবং প্রাকৃতিক সম্পদ নির্ভর।
  • স্থানীয় মহিলাদের জন্য আয়ের উৎস হতে পারে।
  • এটি লোকশিল্প ও সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যের অংশ।
  • পর্যটন শিল্পে নতুন মাত্রা যোগ করতে পারে।

উপসংহার

'ঘঙ' আমাদের মনে করিয়ে দেয়, কীভাবে আমাদের পূর্বপুরুষরা প্রকৃতির সম্পদকে ব্যবহার করে নিজেদের প্রয়োজন মেটাতেন এবং তার মধ্যে শিল্প ও কারুকার্য ফুটিয়ে তুলতেন। এই ভারী, পরিবেশ-বান্ধব বর্ষাতিটি ছিল জঙ্গলমহলের প্রান্তিক মানুষের কঠোর পরিশ্রম এবং সরল জীবনযাত্রার প্রতীক। যখন আমরা আধুনিক জীবনে আরাম-আয়েশের পেছনে ছুটি, তখন এই হারিয়ে যাওয়া শিল্পগুলো আমাদের মনে করিয়ে দেয়, প্রকৃতির সঙ্গে মিশে থাকার এক অনন্য সৌন্দর্য ও মূল্য। এই শিল্পীদের প্রতি আমাদের সশ্রদ্ধ প্রণাম, যাঁরা আমাদের জন্য ফসলের জোগান দেন এবং প্রকৃতির সঙ্গে নিবিড় বন্ধনে আবদ্ধ থাকেন।

আপনার মতামত দিন নিচের কমেন্ট বক্সে। আপনি কি কখনো 'ঘঙ' ব্যবহার করেছেন বা চোখে দেখেছেন? আপনার অভিজ্ঞতা আমাদের সঙ্গে শেয়ার করুন মন্তব্যে।

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

0মন্তব্যসমূহ

We welcome thoughtful discussions. Comments are moderated for quality

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন (0)

#buttons=(Ok, Go it!) #days=(20)

Our website uses cookies to enhance your experience. Check Now
Ok, Go it!