বিদ্যাসাগর ও বাংলার রঙ্গমঞ্চ: এক অজানা নাট্যপ্রেমের গল্প

বিদ্যাসাগর ও বাংলার রঙ্গমঞ্চ: এক অজানা নাট্যপ্রেমের গল্প

লালপেঁচা.in – বাংলার না-বলা কথা
0

বিদ্যাসাগর ও বাংলার রঙ্গমঞ্চ: এক অজানা অধ্যায়

আমরা যখন ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগরের কথা ভাবি, তখন আমাদের মনে ভেসে ওঠে একজন মহান সমাজ সংস্কারক, শিক্ষাবিদ এবং মানবতাবাদীর ছবি। কিন্তু তাঁর জীবনের আরেকটি দিক, যা হয়তো অনেকেরই অজানা, তা হলো নাটক ও নাট্যশালার প্রতি তাঁর গভীর অনুরাগবিদ্যাসাগরের মতো একজন ব্যক্তিত্ব কীভাবে বাংলার নাট্যচর্চাকে দেখেছিলেন এবং তাতে কতটা নিবিড়ভাবে জড়িত ছিলেন, তা সত্যিই বিস্ময়কর। তাঁর নাট্যপ্রেমের ছয়টি আকর্ষণীয় ঘটনা এখানে তুলে ধরা হলো, যা আপনাকে মুগ্ধ করবে। 
ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগরের নাট্যশালায় উপস্থিতি

১. 'কুলীনকুলসর্বস্ব' নাটকের দর্শক বিদ্যাসাগর

১৮৫৮ সালের ২২শে মার্চ, বড়বাজারের গঙ্গাধর শেঠের বাড়িতে রামনারায়ণ তর্করত্নের লেখা বঙ্গভাষার প্রথম নাটক "কুলীনকুলসর্বস্ব"-এর তৃতীয় অভিনয় অনুষ্ঠিত হয়। এই ঐতিহাসিক মুহূর্তে বিদ্যাসাগর মহাশয়কে আমন্ত্রণ জানানো হয়েছিল, এবং তিনি সানন্দে সেই আমন্ত্রণ গ্রহণ করে যথা সময়ে উপস্থিত হন। তিনি অত্যন্ত মনোযোগ সহকারে নাটকটি উপভোগ করেন এবং এর ভূয়সী প্রশংসা করেন। এই ঘটনা থেকেই বোঝা যায়, বাংলার নাট্যচর্চার প্রথম পর্ব থেকেই তিনি এর সাথে ওতপ্রোতভাবে জড়িত ছিলেন।

২. বেলগাছিয়া নাট্যশালার 'রত্নাবলী' দর্শন

এরপর, ১৮৫৮ সালের ৩১শে জুলাই, পাইকপাড়ার রাজা প্রতাপচন্দ্র ও ঈশ্বরচন্দ্র সিংহের 'বেলগাছিয়া নাট্যশালা'-য় বিদ্যাসাগর রামনারায়ণ তর্করত্ন কর্তৃক বাংলা ভাষায় অনূদিত শ্রীহর্ষের "রত্নাবলী" নাটকের অভিনয় দর্শন করেন। এই নাটকের অভিনয় দেখেও তিনি গভীরভাবে মুগ্ধ হয়েছিলেন। এটি প্রমাণ করে যে, তৎকালীন বিভিন্ন নাট্যশালায় গুরুত্বপূর্ণ নাটকের প্রদর্শনীতে তাঁর উপস্থিতি ছিল নিয়মিত।

৩. 'বিধবা-বিবাহ' নাটকে অশ্রুসিক্ত বিদ্যাসাগর

১৮৫৯ সালের ২৩শে এপ্রিল, রামগোপাল মল্লিকের সিঁদুরিয়াপটির বাড়িতে শ্রী উমেশচন্দ্র মিত্রের "বিধবা-বিবাহ" নাটকের অভিনয় অনুষ্ঠিত হয়, যা বিদ্যাসাগর দেখতে যান। উল্লেখ্য, এই বাড়িতেই ১৮৫৩ সালের ২রা মে হিন্দু মেট্রোপলিটন কলেজ স্থাপিত হয়েছিল এবং পরে তা 'মেট্রোপলিটন রঙ্গমঞ্চ' নামে পরিচিতি লাভ করে। কেশবচন্দ্র সেন ও তাঁর দলভুক্ত সকলেই এই নাটকে অভিনয় করেছিলেন, যেখানে কেশবচন্দ্র সেন ছিলেন মঞ্চাধ্যক্ষ।

কেশবচন্দ্র সেনের ভাই প্রতাপচন্দ্র মজুমদার তাঁর লেখায় উল্লেখ করেছেন যে, পণ্ডিত ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর এই নাটকটি একাধিকবার দেখতে এসেছিলেন, এবং প্রতিবারই অভিনয় দর্শন করে তাঁর চোখে উষ্ণ জলের ধারা প্রবাহিত হয়েছিল। এতে অবাক হওয়ার কিছু নেই, কারণ তিনিই তো তদানীন্তন বিধবাদের সমাজে যোগ্য সম্মান, মর্যাদা এবং অধিকার প্রদানের জন্য জীবনভর সংগ্রাম করেছিলেন।

৪. পাথুরিয়াঘাটা বঙ্গ নাট্যশালার কার্যনির্বাহক কমিটিতে বিদ্যাসাগর

মহারাজা যতীন্দ্রমোহন ঠাকুরের "পাথুরিয়াঘাটা বঙ্গ নাট্যশালা"-র (১৮৬৫-১৮৭৩) কার্যনির্বাহক কমিটি গঠনের সময় স্বয়ং বিদ্যাসাগর এবং মাইকেল মধুসূদন দত্ত এই কমিটিতে ছিলেন। আচার্য কৃষ্ণকমল ভট্টাচার্য মহাশয় দেখেছিলেন যে, বিদ্যাসাগর এই রঙ্গমঞ্চের তত্ত্বাবধানের কাজ অত্যন্ত দক্ষতার সাথে সামলাতেন। তাঁর এই পদাধিকার তৎকালীন নাট্যজগতের প্রতি তাঁর দায়বদ্ধতা এবং প্রশাসনিক দক্ষতার পরিচায়ক।

৫. বেঙ্গল থিয়েটার ও 'শর্মিষ্ঠা'র বিতর্কিত অধ্যায়

১৮৭৩ সালের ১৬ই আগস্ট মাইকেল মধুসূদন দত্ত রচিত "#শর্মিষ্ঠা" নাটক-এর অভিনয় দ্বারা 'বেঙ্গল থিয়েটার'-এর উদ্বোধন হয়। কথিত আছে, এই থিয়েটারের কার্যনির্বাহক কমিটিতেও বিদ্যাসাগর ও মাইকেল ছিলেন। এই অভিনয়ের পূর্ব পর্যন্ত স্ত্রী-ভূমিকায় পুরুষ অভিনেতারাই অভিনয় করতেন। কিন্তু মাইকেলের পরামর্শে এই থিয়েটারেই সর্বপ্রথম স্ত্রীলোকের ভূমিকায় স্ত্রীলোকদের দ্বারা অভিনয় করানোর জন্য চারজন অভিনেত্রী নিয়োগ করা হয়।

তবে, একটি বিতর্কিত তথ্য প্রচলিত আছে যে, বিদ্যাসাগর মহাশয় এর বিরোধী ছিলেন এবং এই কারণে তিনি বেঙ্গল থিয়েটারের কার্যনির্বাহী কমিটির পদ থেকে পদত্যাগ করেন। কিন্তু দুজন বিদ্যাসাগর গবেষকের সাথে কথা বলে জানা যায় যে, এই তথ্য কতটুকু সত্য, তা বলা কঠিন। কারণ, যিনি নারীদের সমাজে সসম্মানে ও মর্যাদার সাথে প্রতিষ্ঠিত করার জন্য জীবনের অধিকাংশ সময় সংগ্রাম করেছেন, সেই বিদ্যাসাগরের পক্ষে বারবণিতা বা বারাঙ্গনাদের প্রতি এমন আচরণ করাটা অনেক বিদ্যাসাগর গবেষকই মানতে পারেন না। আমিও এই মতের সমর্থক।

৬. 'নীলদর্পণ' ও চটিজুতো ছুড়ে মারার কিংবদন্তি

বিদ্যাসাগর সম্বন্ধে আর একটি কিংবদন্তি যা তদানীন্তন সময় এবং আজও অনেক শিক্ষিত মানুষের মুখে মুখে ফেরে, তা হলো—তিনি নাকি ''নীলদর্পণ'' নাটকে উড সাহেবের ভূমিকায় অর্ধেন্দুশেখর মুস্তাফির অভিনয় দেখে এতটাই উত্তেজিত ও আত্মহারা হয়ে গিয়েছিলেন যে, সক্রোধে আসন থেকে উঠে দাঁড়িয়ে রঙ্গমঞ্চস্থ অভিনেতা শ্রী অর্ধেন্দুশেখর মুস্তাফির দিকে নিজের চটিজুতো সজোরে নিক্ষেপ করেছিলেন। অর্ধেন্দুশেখর নিজেকে ধন্য মনে করে তৎক্ষণাৎ সেই জুতো নিজের মস্তকে ধারণ করে বিদ্যাসাগর মহাশয়কে সশ্রদ্ধ প্রণাম নিবেদন করেছিলেন।

তবে, ইন্দ্র মিত্রের মতে, এটি অমূলক কিংবদন্তি মাত্র। এই ঘটনার কোনো সমসাময়িক লিখিত প্রমাণ নেই। বিদ্যাসাগর চটিজুতো ছুঁড়ে নাও মেরে থাকতে পারেন। আবার মেরে থাকলেও এতে বিস্মিত হবার মতো কিছু নেই। আসলে ওই কাজ তাঁর মতো ভাবপ্রবণ ব্যক্তির পক্ষে আদেও সম্ভব নয়। তবে, মারুন বা নাই মারুন, যে নাটক তখন সমস্ত বাংলাকে তোলপাড় করেছিল, বাঙালি মাত্রকেই ক্ষেপিয়ে তুলেছিল, সে নাটক যে বিদ্যাসাগর একবার নয়, একাধিকবার দেখেছিলেন তা নিয়ে কোনো সন্দেহ থাকতে পারে না।

কিন্তু, আপনি যেমনটি বলেছেন, কোথাও তো এ কথা লেখা নেই যে বিদ্যাসাগর এই নাটক দেখেছিলেন! গত মাসেই দুজন বিদ্যাসাগর গবেষকের সাথে কথা হলে তাঁরাও একমত হন যে, বিষয়টি 'বিতর্কিত'। হয়তো আরও পুরোনো পুঁথি ঘেঁটে এই ব্যাপারে আমরা জানতে পারব।

উপসংহার: নাটকের গুরুত্ব ও বিদ্যাসাগর

এই তথ্যগুলো থেকে একটি বিষয় পরিষ্কার যে, তৎকালীন সমাজের গুণীজনেরা—সে কবি, লেখক, সমাজ সংস্কারক, বা অবতারই হোন না কেন—কেউই নাটককে অবহেলা করেননি। তাঁরা ছিলেন সংস্কৃতিমনস্ক, এবং নাটকের মাধ্যমে সমাজকে প্রভাবিত করার শক্তিকে তাঁরা গুরুত্ব দিতেন।

স্বয়ং ঠাকুর শ্রীরামকৃষ্ণও থিয়েটার দেখতে ভালোবাসতেন, এবং একাধিকবার তিনি তাঁর প্রিয় গিরিশের নাটক দেখতে যেতেন। তাঁর সেই থিয়েটার বা নাটক নিয়ে বিখ্যাত উক্তি দিয়েই এই লেখার ইতি টানা যায়:

"থিয়েটার দেখলে লোকশিক্ষা হয়..."

অর্থাৎ, থিয়েটার বা নাটক দিয়ে সমাজের বাস্তব চিত্রটি জনগণের সামনে সহজেই তুলে ধরা যায়। একটি থিয়েটার বা নাটক বলে দেয়, আমাদের কি করণীয় আর কোনটাই বর্জনীয়।


গ্রন্থ ঋণ: ১. বিদ্যাসাগর, ২. অচেনা বিদ্যাসাগর, ৩. কলকাতার বিদ্যাসাগর।

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

0মন্তব্যসমূহ

We welcome thoughtful discussions. Comments are moderated for quality

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন (0)

#buttons=(Ok, Go it!) #days=(20)

Our website uses cookies to enhance your experience. Check Now
Ok, Go it!