পাথরবুড়ি: বীরভূমের লৌকিক দেবীর পুরানো রীতি ও পথিকের বিশ্বাস🌾

পাথরবুড়ি: বীরভূমের লৌকিক দেবীর পুরানো রীতি ও পথিকের বিশ্বাস🌾

লালপেঁচা.in – বাংলার না-বলা কথা
0

বীরভূম ছিল "রাঢ়" অঞ্চলের অংশ। এই রাঢ়ের উত্তর-পূর্বে ছিল গৌড়, পূর্বে গঙ্গা, দক্ষিণে সমতট বা মেদিনীপুর এবং পশ্চিমে মিথিলা। রাঢ়ের দুটি অংশ ছিল - উত্তর রাঢ় এবং দক্ষিণ রাঢ়। গঙ্গা, ভাগীরথী এবং অজয় ​​নদী দ্বারা বেষ্টিত অঞ্চলটি হল উত্তর রাঢ়, যা রাঢ়ের প্রধান ভূমি। অন্যদিকে, অজয় ​​এবং দামোদরের মধ্যবর্তী ভূমি হল দক্ষিণ রাঢ়, যা রাঢ়ের দক্ষিণ সম্প্রসারণ বলা হয় ।

ত্রয়োদশ শতাব্দীর ইতিহাসবিদ মীনহাজ উদ্দিনের লেখা "তবকৎ-ই-নাসিরি" বইটিতে বলা হয়েছে যে গঙ্গার পশ্চিমে ছিল "রাল" — যার অর্থ "রাঢ়"। অতএব, মীনহাজের লেখার উপর ভিত্তি করে বলা যেতে পারে যে "রাঢ়" নামটি দ্বাদশ থেকে ত্রয়োদশ শতাব্দীর প্রথমার্ধ পর্যন্ত প্রচলিত ছিল।

"রহ্"  ধাতুর সঙ্গে ভাবার্থে "ঘঞ্"  প্রত্যয় যোগে যে "রাঢ়"  শব্দ তৈরি এবং এর অর্থ "নিয়ত গতিশীলতা"। প্রকৃতপক্ষে, ত্যাগব্রতধারী, সদা পরিব্রাজক আর্য ঋষিরাই ছিলেন এই গতিশীলতার প্রতীক। তারা এক স্থান থেকে অন্য স্থানে ঘুরে বেড়াতেন, এবং তাই তারা "রাঢ়া" ছিলেন। তাঁদের বিহারক্ষেত্র হিসেবে লালমাটির এই ভূমির নামই হয়ে ওঠে "রাঢ়"

এই রাঢ়ভূমির উত্তর অংশের নামকরণ করা হয়েছিল "বীরভূমি"। খ্রিস্টীয় ১৩শ থেকে ১৪শ শতাব্দীর "মহেশ্বরের কুলপঞ্জিকা"-তে আমরা এই নামটির উল্লেখ দেখতে পাই:

বীরভূঃ কামকোটী স্যাৎ প্রাচ্যাং গঙ্গাজয়ান্বিতা।

অর্থাৎ, সেই সময় থেকেই রাঢ়ভূমির নতুন নাম “বীরভূম” হিসেবে স্বীকৃত। পরে আবার এই বীরভূমের আরেক নাম হয় “ঝাড়খণ্ড”। অঞ্চলটিতে প্রচুর খণ্ড খণ্ড ঝোপ-ঝাড় ও জঙ্গল ছিল বলে এই নামকরণ। আজও আমরা খণ্ডাংশ বোঝাতে “ঝোপ-ঝাড়”, “বাঁশঝাড়” ইত্যাদি শব্দ ব্যবহার করি।

🧘‍♂️ ঋষিদের বীরভূম ও লৌকিক বিশ্বাসের জন্ম

ঘন জঙ্গলাকীর্ণ এই বীরভূমের মাটি জড়িয়ে ছিল ঋষি ও সাধকদের সাধনক্ষেত্রের সঙ্গে। যেমন—

👉ভাণ্ডীরবনে ঋষি বিভাণ্ডক।

👉বক্রেশ্বরে শ্বেতমুনি, শুক্রাচার্য, পতঞ্জলি ও অষ্টাবক্র।

👉তারাপীঠে বশিষ্ঠ।

👉বেহিড়ায় বৃহদারণ্যক মুনি।

👉দুবসায় মহর্ষি দুর্বাসা।

👉কাঞ্চীক্ষেত্রে মহর্ষি রুরু।

এই জঙ্গলের জন্যই পাণ্ডবরা তাঁদের অজ্ঞাতবাসের নিরাপদ স্থান হিসেবে বীরভূমকে বেছে নিয়েছিলেন।

পাথর থেকে দেবী – “ পাথরবুড়ির ” জন্মকথা

সেই সময়, ঘন জঙ্গলের মধ্যে চলাচল ছিল কঠিন। বনজন্তুর ভয়, পথ হারানোর আশঙ্কায় গ্রামের মানুষ পাথরের ঢেলা বা টুকরো হাতে করে যাতায়াত করত। কারণ—

👉বয়স্করা লাঠি হাতে বের হতেন ।

👉যুবকরা বা তরুণরা পাথরের ঢেলা নিয়ে মাসি-পিসির বাড়ি যেতেন ।

👉গন্তব্যে পৌঁছে সেই পাথর ফেলে দিতেন বাড়ির সামনে ।

এইভাবে, অনেক পাথর জমে ছোট ছোট স্তূপ তৈরি হত।—এ যেন পথচিহ্ন বা “ আদি মাইলস্টোন ”। এই পাথরের স্তূপ ভ্রমণকারীদের পথচ্যুতি হওয়া থেকে রক্ষা করার জন্য একটি পথনির্দেশকের মতো কাজ করেছিল।

সময়ের সাথে সাথে, এই পাথরের স্তূপ লোকবিশ্বাসের কেন্দ্রবিন্দুতে পরিণত হয়।মানুষ বিশ্বাস করতে শুরু করে যে—এই পাথরই তাদের রক্ষা করে। হয়তো সেই বিশ্বাস থেকে, একটি নতুন লৌকিক দেবীর জন্ম হয় - "পাথর বুড়ি"।

সিউড়ি-রাজনগর পিচ রাস্তার ধারে, বড়কোন্দা, বীরভূম — লৌকিক দেবী পাথরবুড়ির থান

আজও অনেক জায়গায়, এই পাথরের স্তূপগুলি "পাথরবুড়ির থান" নামে পরিচিত। পথচারীরা দেবীর প্রতি শ্রদ্ধা জানায় যাই। এবং ইট বোঝাই লরিগুলি শ্রদ্ধার নিদর্শন হিসাবে থানের পাশে কয়েটি ইট রেখে যায়।

🙏 বিশ্বাসের প্রতীক — বড়কোন্দার “পাথরবুড়ি”

সিউড়ি-রাজনগর পিচ রাস্তার ধারে বড়কোন্দা গ্রামে এখনও একটি "পাথরবুড়ির থান" রয়েছে। যেখানে সাধারণ মানুষ বিশ্বাস এখনো অটুট। দেবীরূপে পাথর দেবী পূজা করা হয় ১০০% বিশ্বাস করেই।

🔴 আমাদের একমাত্র ইউটিউব চ্যানেল — লালপেঁচা

Post a Comment

0Comments

We welcome thoughtful discussions. Comments are moderated for quality

Post a Comment (0)

#buttons=(Ok, Go it!) #days=(20)

Our website uses cookies to enhance your experience. Check Now
Ok, Go it!