🔥 সিঙ্গাড়া – শুধু একটি ভাজা খাবার নয়, এক ঐতিহাসিক আবিষ্কার
সন্ধ্যা নামার সাথে সাথে রাস্তাঘাটে ভেসে আসে এক চেনা গন্ধ— গরম গরম সিঙ্গাড়া। আলুর পুরভর্তি এই তিন কোনা ভাজা খাবার আজ বাংলা তথা সারা ভারত জয়ের পথে। কিন্তু আপনি কি জানেন, এই সিঙ্গাড়ার জন্ম হয়েছিল এক রাজদণ্ড, এক হালুইকর ও তার স্ত্রীর বুদ্ধিমত্তার গল্প থেকে?
১৭৬৬ সালে কৃষ্ণনগরের মহারাজ কৃষ্ণচন্দ্রের রাজসভায় ঘটে যাওয়া একটি ঘটনার সূত্র ধরেই জন্ম নেয় এই জনপ্রিয় বাংলা এবং ভারতীয় সিঙ্গাড়া।
👑 কৃষ্ণচন্দ্রের রাজসভা ও সেই ঐতিহাসিক দণ্ড
১৭৬৬। কৃষ্ণনগরের রাজা কৃষ্ণচন্দ্র রায়, যিনি ডায়াবেটিসে ভুগছিলেন। একদিন রাজসভায় ঠাণ্ডা লুচি পাঠানোয় এতটাই ক্ষুব্ধ হয়েছিলেন যে,— রাজবাড়ির হালুইকরকে শূলে চড়ানো হোক। অনেক অনুনয়-বিনয় করার পর, হালুইকারকে মুক্তি দেওয়া হয় এবং রাজা তাকে তিন দিনের মধ্যে দেশ ছেড়ে চলে যাওয়ার নির্দেশ দেন।
👩🍳 হালুইকরের স্ত্রীর কৌশল ও সৃষ্টি ‘সমভুজা’
দেশত্যাগের আগে হালুইকরের স্ত্রী ধরিত্রী দেবী সিদ্ধান্ত নেন— রাজার সামনে হাজির হয়ে প্রমাণ করবেন, লুচি ঠাণ্ডা হলেও সুস্বাদু হতে পারে। তিনি রাজসভায় এসে জানান, এমন এক লুচি তৈরি করবেন, যেটি খানিক দেরিতে খেলেও গরম লাগবে এবং মুখ পুড়বে না। রাজা কৌতূহলী হয়ে পাকশালে পাঠান তাঁকে।
সেখানেই ঘটে ঐতিহাসিক ঘটনা— ধরিত্রী দেবী ময়দার তাল বেলে, আলুর তরকারির পুর ভরে, এক সমভুজ (ত্রিভুজ) আকার তৈরি করেন এবং ঘিয়ে ভেজে তৈরি করেন এক অভিনব ভাজা— যেটি পরে পরিচিত হয় ‘সিঙ্গাড়া’ নামে।মহারাজ কৃষ্ণচন্দ্রের রাজসভায় রাজ-হালুইকর গুণীনাথ হালুইকরের পুত্র গিরীধারী হালুইকরের স্ত্রী ধরিত্রী দেবী ছিলেন এই সৃজনশীল খাবারের প্রকৃত উদ্ভাবক।
👑 রাজা কৃষ্ণচন্দ্রের বিস্ময় ও পুরস্কারমহারাজ কৃষ্ণচন্দ্র ছিলেন কৃষ্ণনগরের রাজা, যাঁর রাজসভায় এই নতুন খাবারটি প্রথম পরিবেশিত হয়। রাজা খেতে খেতেই অবাক হয়ে গেলেন - খাবার গরম ছিল, মুখে পুড়েনি, স্বাদ অসাধারণ ছিল। রাজা কৃষ্ণচন্দ্র খুশি হয়ে মুক্তার মালাটি দেবী ধরিত্রীর হাতে তুলে দিলেন এবং হালুইকরের শাস্তি ক্ষমা করে দিলেন।
🌏 ইতিহাস ও ভাষাবিদদের বিশ্লেষণ
মনে করেন, সিঙ্গার পূর্বসূরি পারস্যের ‘সাম্বসা’। পারস্য মানুষ নবম শতকে মাংস ও শাকসবজি দিয়ে বানাতেন এক সুন্দর ভাজা খাবার, যেটি আপনার সংস্করণে ‘সামোসা’ বা ‘সিঙ্গাড়া’বিদ পরিচিত হয়।
ভাষাবিদদের মতে নামের বিবর্তন হয়েছিল এভাবে:
সমভুজা → সম্ভোজা → সাম্বোসা → সামোসা → সিঙ্গাড়া
অন্য একটি মত অনুসারে:
সমভুজা → সম্ভোজা → সিভুসা → সিঁঙুরা (নদীয়ার কথ্যরূপ) → সিঙ্গাড়া
🧙 শাক্ত সাধক ও সভাকবি রামপ্রসাদ ও সিঙ্গাড়া:
মহারাজ কৃষ্ণচন্দ্রের সভাকবি ও শাক্ত সাধক রামপ্রসাদ সেন সন্ধ্যায় সিঙ্গাড়া খেতেন। রাজসভা থেকে দোল পূর্ণিমার দিনে, বাইশটি সুসজ্জিত হাতি নিয়ে উমিচাঁদের কাছে উপহার পাঠানো হয়েছিল— বাইশশোটি সিঙ্গাড়া।ইতিহাসের প্রথম ইংরেজ রবার্ট ক্লাইভ , সিঙ্গাড়ার স্বাদ পান কৃষ্ণচন্দ্রের দরবারে।
🧾 ঐতিহাসিক গুরুত্ব:
এই গল্প শুধুই কাহিনি নয়, এটি বাংলার রান্নার ইতিহাসে এক গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায়।
👉সাহিত্যিক ও শাক্ত সাধক রামপ্রসাদ সেন প্রতি সন্ধ্যায় সিঙ্গাড়া খেতেন।
👉রবার্ট ক্লাইভ-এর ভারতীয় সিঙ্গাড়ার সাথে প্রথম পরিচয় হয় এই রাজসভাতেই, কৃষ্ণচন্দ্রের সৌজন্যে।
👉দোলপূর্ণিমার সন্ধ্যায় রাজসভা থেকে পাঠানো হয় বাইশটি হাতি এবং বাইশশোটি সিঙ্গাড়া।
🧪 ডায়াবেটিস, চিকিৎসাবিজ্ঞান ও সিঙ্গাড়ার অমরতা
চিকিৎসার পরিভাষায়, ডায়াবেটিস রোগীদের ঘন ঘন অল্প পরিমাণে খাওয়ার পরামর্শ দেওয়া হয়। কিন্তু ১৭৬৬ সালের সেই যুগে, রাজ-চিকিৎসকের নির্দেশে তৈরি খাবারই হয়ে উঠেছিল ডায়াবেটিস আক্রান্ত রাজার জন্য অনন্য উপহার— ত্রিভুজাকৃতির সিঙ্গাড়া।
🪑 আজও সর্বত্রগামী সেই সিঙ্গাড়া
আজও, শহরের অভিজাত বাড়িতে হোক বা গ্রামের চায়ের দোকানে হোক— সিঙ্গাড়া অমলিন। সেই দেবী ধরিত্রীর সৃষ্ট “সমভুজা”-ই হয়ে উঠেছে বাংলার প্রতিটি বিকেলের মুখরোচক সঙ্গী। ইতিহাস ভুলে গেলেও, স্বাদে কোনো ভেজাল নেই।
উপসংহার : সিঙ্গাড়া, যার জন্ম হয়েছিলো কৃষ্ণনগরের রাজসভায়, আজ একটি ঐতিহ্যবাহী খাদ্য যা তার তিনকোনা আকৃতির জন্য বিখ্যাত। এর কাহিনী আমাদের ইতিহাস, সংস্কৃতি ও রান্নার ঐতিহ্যের একটি অংশ। এই ক্ষুদ্র কিন্তু সুস্বাদু খাবারটির যাত্রা প্রাচীন কালের পারস্য থেকে শুরু করে আধুনিক ভারতে এসে পৌঁছেছে, যা এখনও সবার প্রিয়।
We welcome thoughtful discussions. Comments are moderated for quality