হিংলাজ মাতা মন্দির: বালুচিস্তানের বুকে এক পবিত্র শক্তিপীঠ

হিংলাজ মাতা মন্দির: বালুচিস্তানের বুকে এক পবিত্র শক্তিপীঠ

লালপেঁচা.in – বাংলার না-বলা কথা
0

hinglaj-shakti-peeth-balochistan
 
Author Image
✍️:Raju Biswas

🙏পাকিস্তানের একটি প্রদেশ ছিল বালোচিস্তান, সেখানে দুর্গম পার্বত্য অঞ্চলে অবস্থিত হিংলাজ মাতা মন্দির (ببلوچی و اردو: ہنگلاج ماتا‎‎) হিন্দুধর্মের শাক্ত উপাসকদের নিকট এক পবিত্র তীর্থস্থান। 

হিংলাজ মাতা মন্দির, শাক্ত হিন্দুদের অন্যতম পবিত্র তীর্থস্থান, সমগ্র দক্ষিণ এশিয়ার শাক্ত সম্প্রদায়ের কাছে এক অতিপবিত্র শক্তিপীঠ হিসেবে পূজিত।বেলুচিস্তানের  লাসবেলা জেলার মাকরান উপকূলে হিংলাজ শহরে অবস্থিত। হিঙ্গোল জাতীয় উদ্যানের গভীরে অবস্থিত, এই শ্রদ্ধেয় স্থানটি হিংলাজ দেবী মন্দির, হিঙ্গুলা দেবী মন্দির এবং নানী মন্দির নামেও পরিচিত। এটি ৫১টি পবিত্র শক্তিপীঠের মধ্যে একটি এবং পাকিস্তানের দুটি বিদ্যমান শক্তিপীঠের মধ্যে একটি। কিছু ঐতিহ্য এটিকে শক্তিপীঠের মধ্যে প্রথম বলেও মনে করে।

অবস্থান ও পরিবেশ :

hinglaj-shakti-peeth-balochistanহিংলাজ মাতা মন্দির অবস্থিত বালোচিস্তানের লাসবেলা জেলার মাকরান উপকূলে হিংলাজ শহরের কাছে। এটি হিংগোল নদীর তীরে, হিংগোল ন্যাশনাল পার্কের একটি পর্বতগাত্রের গুহায় অবস্থিত। হিংলাজ শক্তিপীঠ আরব সাগর থেকে প্রায় ১২ মাইল (১৯ কিমি) এবং সিন্ধু নদীর বদ্বীপ থেকে ৮০ মাইল (১৩০ কিমি) পশ্চিমে অবস্থিত। স্থানাঙ্কগুলি প্রায় - ২৫°৩০'৫০" উত্তর- ৬৫°৩০'৫৫" পূর্ব। মন্দিরটি হিঙ্গোল জাতীয় উদ্যানের কেন্দ্রস্থলে কীরথর পর্বতের রুক্ষ পাহাড় দ্বারা বেষ্টিত শুষ্ক মাকরান মরুভূমির একটি সরু পাহাড়ি গিরিখাতে অবস্থিত।
hinglaj-shakti-peeth-balochistan

 কোন মূর্তি নেই, কেবল বিশ্বাস। ভক্তরা গুহার ভিতরে সিঁদুর মাখানোদেবীর প্রাকৃতিক পাথরের রূপের পূজা করেন। সিঁদুর দ্বারা মাখা একটি প্রাকৃতিকভাবে গঠিত অনিয়মিত পাথরকে হিংলাজ মাতা হিসেবে পূজা করা হয়। “হিংলাজ” নামটি সংস্কৃত শব্দ “হিঙ্গুলা” থেকে উদ্ভূত বলে মনে করা হয়, যা পবিত্র শিলায় ব্যবহৃত লাল সিঁদুর থেকে উদ্ভূত। হিন্দু পৌরাণিক কাহিনি অনুসারে, এটিই সেই স্থান যেখানে দেবী সতীর ব্রহ্মরন্ধ্র (মাথার খুলির উপরের অংশ) পতিত হয়েছিল—ফলে এটি সর্বাপেক্ষা গুরুত্বপূর্ণ শক্তিপীঠগুলির একটি বলে গণ্য হয়। এখানে দেবীকে হিংলাজ মাতা হিসেবে এবং ভগবান শিবকে ভৈরব ‘চাঁদ’ রূপে পূজা করা হয়।

কাছাকাছি পবিত্র স্থান:

হিংলাজ মাতা মন্দিরের আশেপাশের এলাকায় অন্যান্য পবিত্র স্থানও রয়েছে যেমন:  গণেশ মন্দির ,কালী মাতা মন্দির, গুরু গোরখনাথ দুনি , ব্রহ্ম কুণ্ড, তীর কুণ্ড, গুরু নানক খাড়াও, রাম ঝরোখা বেথক , চৌরাসি পাহাড়ের অনিল কুণ্ড , চন্দ্রকূপ (একটি আগ্নেয়গিরির মাটির পাহাড়) , খারী নদী ও অঘোর পূজাস্থান

hinglaj-shakti-peeth-balochistan
 আন্তঃধর্মীয় সম্প্রীতির প্রতীক:

 হিংলাজ মাতা কেবল হিন্দুদের দ্বারাই নয়, স্থানীয় মুসলিম সম্প্রদায়ের দ্বারাও শ্রদ্ধাশীল, যারা তাঁকে শ্রদ্ধার সাথে নানী মাতা বলে ডাকে। এই অঞ্চলের অনেক মুসলমান দেবীর শক্তিতে বিশ্বাস করে এবং তাদের শ্রদ্ধা নিবেদন করে। এই অনন্য সাংস্কৃতিক সমন্বয় হিংলাজ মন্দিরকে হিন্দু-মুসলিম সম্প্রীতির এক বিরল উদাহরণ করে তোলে।

বার্ষিক হিংলাজ যাত্রা :

প্রতি বছর, পাকিস্তান এবং ভারত উভয় দেশ থেকে হাজার হাজার ভক্ত কঠিন হিংলাজ যাত্রায় অংশগ্রহণ করেন, যা পাকিস্তানের বৃহত্তম হিন্দু তীর্থস্থান হিসেবে বিবেচিত হয়। এই পবিত্র যাত্রা ১৩৫৩ সালের বাংলা ক্যালেন্ডার বছরে (১৯৪৬ খ্রিস্টাব্দ) শুরু হয়েছিল এবং সাধারণত চৈত্র পূর্ণিমা (মার্চ-এপ্রিল) সময়কালে অনুষ্ঠিত হয়, যা ৪-৫ দিন স্থায়ী হয়।

তীর্থযাত্রা করাচি থেকে শুরু হয়ে হাব, লাসবেলা এবং প্রায় ২৫০ কিলোমিটার কঠোর, পাথুরে মরুভূমি পেরিয়ে মন্দিরে পৌঁছায়। তীব্র তাপ, ধুলো এবং শারীরিকভাবে কষ্টকর পথ সত্ত্বেও, অসংখ্য ভক্ত দেবীর আশীর্বাদ পেতে হেঁটে বা উটে চড়ে যান।ভক্তরা পথের বেশ কয়েকটি পবিত্র স্থানে প্রার্থনা করেন, যার মধ্যে রয়েছে: 

 চিলগজ: একটি স্থান যেখানে একটি গাছ অলৌকিকভাবে বৃদ্ধি পায়, হিংলাজ মাতার আশীর্বাদপ্রাপ্ত বলে বিশ্বাস করা হয়।

বালু কা টিলা: বালির একটি ঢিবি যেখানে তীর্থযাত্রীরা আধ্যাত্মিক পবিত্রতার পরীক্ষা হিসেবে হেঁটে যান - বিশ্বাস করা হয় যে পবিত্র হৃদয়ের অধিকারীরা সহজেই অতিক্রম করতে পারেন।

hinglaj-shakti-peeth-balochistan
 পীঠস্থান ও কিংবদন্তি

হিংলাজ মন্দির হিন্দুধর্মের ৫১ শক্তিপীঠের অন্যতম, যেখানে পুরাণ মতে সতীর মস্তক পতিত হয়েছিল। সতীর আত্মাহুতির পর, শিব তাঁকে কাঁধে করে পৃথিবীজুড়ে ঘুরতে থাকেন। তখন বিষ্ণু সুদর্শন চক্র দিয়ে সতীর দেহ খণ্ড খণ্ড করেন। এই খণ্ডগুলি যেখানে পড়েছিল, সেখানেই এক-একটি শক্তিপীঠের সৃষ্টি হয়। হিংলাজ সেই পবিত্র স্থানগুলির একটি।

সাহিত্য ও সংস্কৃতিতে হিংলাজ

১৯৫৫ সালে অবধূত রচিত উপন্যাস "মরুতীর্থ হিংলাজ" এই তীর্থযাত্রা ও হিংলাজ মাতার ভাবগম্ভীরতা ও কঠিন যাত্রাপথের এক সাহিত্যমূল্যপূর্ণ দলিল। উপন্যাসটি তীর্থযাত্রীদের মানসিক টানাপোড়েন, অপরাধবোধ ও আত্মশুদ্ধির আকাঙ্ক্ষা ফুটিয়ে তোলে। 

hinglaj-shakti-peeth-balochistan

উপসংহার :হিংলাজ মাতা মন্দির কেবল একটি ধর্মীয় স্থান নয়; এটি ইতিহাস, আধ্যাত্মিকতা, স্থানীয় সংস্কৃতি ও মানবিক সংহতির প্রতীক। পাকিস্তানের মতো একটি মুসলিম প্রধান দেশে হিংলাজ মাতার এই তীর্থ স্থানটি হিন্দু-মুসলমান মিলনেরও এক অপূর্ব নিদর্শন। যুগে যুগে শাক্ত উপাসকদের কাছে এই মন্দির তাদের বিশ্বাস ও ভক্তির পরম গন্তব্য হয়ে উঠেছে।

Post a Comment

0Comments

We welcome thoughtful discussions. Comments are moderated for quality

Post a Comment (0)

#buttons=(Ok, Go it!) #days=(20)

Our website uses cookies to enhance your experience. Check Now
Ok, Go it!