কার্বি জনগোষ্ঠী ‘মিকির’ (Mekar) নামে ভারতীয় সংবিধানে অন্তর্ভুক্ত হয়েছে। উত্তর-পূর্ব ভারতের বৃহৎ জনজাতিগুলোর মধ্যে কার্বি বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য, যারা প্রধানত আসামের পার্বত্য অঞ্চলে বসবাস করে। এরা টিবেটো-বার্মিজ ভাষা পরিবারের অন্তর্ভুক্ত এবং দেহগত বৈশিষ্ট্যে মোঙ্গলয়েড জনগোষ্ঠীর অন্তর্গত। কার্বিরা নিজেদের ‘আংলং’ (Anglong) নামে ডাকে, যার অর্থ ‘মানুষ’। আসামের উত্তর কাছাড়, গোলাঘাট, নগাঁও, লক্ষীমপুর ছাড়াও মেঘালয়, মনিপুর, নাগাল্যান্ড এবং বাংলাদেশের সিলেট অঞ্চলে এদের বসতি রয়েছে।
ঐতিহাসিক পটভূমি ও নামকরণের জনশ্রুতি
প্রাচীনকালে কার্বিদের ‘মিকির’ নামে ডাকা হতো। ১৯৭৬ সালে এই নাম বদলে ‘কার্বি’ রূপে তাদের পরিচিতি লাভ ঘটে। ‘কার্বি’ শব্দটি অসমীয়া থেকে উদ্ভূত বলে ধারণা করা হয়, যার অর্থ “পর্বতের পাদদেশে বসবাসকারী জাতি”। কারো মতে, ‘মিকির’ শব্দটি এসেছে ‘মেকরি’ নামক এক রাজকন্যার নাম থেকে। অন্য এক জনশ্রুতি অনুসারে, এক কার্বি ব্যক্তি তার হারানো পোষা বিড়াল খুঁজতে গিয়ে অসমীয়া প্রতিবেশীকে বলে “Mang Kri” (মানে বিড়াল খুঁজছি), যা থেকে ‘মিকির’ নামটি এসেছে।
জনগোষ্ঠী ও সামাজিক গঠন
কার্বি সমাজে পাঁচটি প্রধান কুল বা গোত্র রয়েছে:
১. ইংহি
২. ইংতি
৩. তেৰাং
৪. টেৰণ
৫. তিমুং
এই কুলগুলির অধীনে আরও শতাধিক উপকুল বা ‘কুর’ (Kur) রয়েছে। এই কুল ও কুর ভিত্তিক সমাজ বহির্বিবাহ প্রথার অনুসারী এবং পিতৃতান্ত্রিক। অঞ্চলভিত্তিক কার্বিদের ভাগ করা হয় চারটি প্রধান গোষ্ঠীতে: চিন্তন, আমরি, দুন্দ্রানি ও রঙ্গন।
জীবনধারা ও পেশা
কার্বিরা ঐতিহ্যগতভাবে কৃষিজীবী এবং পার্বত্য অঞ্চলে ঝুম চাষে পারদর্শী। যদিও আজকাল কৃষিকাজ হ্রাস পেয়েছে, অনেকেই বেছে নিয়েছে বাঁশ ও বেতশিল্প, মাছচাষ ও হস্তশিল্পকে পেশা হিসেবে। তাদের জীবনে বাঁশের ব্যবহার অপরিসীম — বাসগৃহ নির্মাণ থেকে খাদ্য প্রস্তুতিতে, এমনকি বাদ্যযন্ত্র ও অলংকার তৈরিতে পর্যন্ত।
পোশাক ও অলংকার
পুরুষরা পরেন ধুতি সদৃশ “রিকং” (Rikong), ওপরের অংশে “চৈই” (Choi) নামক হাতকাটা শার্ট ও “পহু” (Pohu) কোমরবন্ধনী। নারীরা “পিনি” (Pini), “ভ্যানকক” (Vankok), “জিশো” (Jiiso), ও “পিকক” (Pekok) নামক বিশেষ পোশাক ও চাদর ব্যবহার করেন। অলংকার হিসেবে ব্যবহার করেন ধান ও বীজ দিয়ে তৈরি লেকো, সিকি, পেংমুই ইত্যাদি। পুরুষরাও গলায় হার পরেন, যেমন: লেকো মঞ্জিলি, লেকো চোয়াই। নারীরা তিন প্রকারের বালা পরেন— রয়তাহু, রয়চেতাং ও রয়পেনখা।
ধর্ম ও বিশ্বাস
কার্বি ধর্মীয়ভাবে মূলত হিন্দু প্রভাবে বিশ্বাসী হলেও তাদের মধ্যে সর্বপ্রাণবাদ ও আত্মা-অবিনশ্বরতা প্রচলিত। প্রাকৃতিক শক্তিকে দেবতা হিসেবে পূজা করেন—যেমন “থিংপি-থেংসো” বনদেবতা, এবং গৃহরক্ষক দেবতা “হেমফু”। পূজায় ছাগল ও শুকর উৎসর্গ করা হয়। তারা বিশ্বাস করে মৃত্যু পর আত্মা যমের রাজ্যে যাত্রা করে এবং শ্রাদ্ধ অনুষ্ঠানের মাধ্যমে তা শান্তি পায়। বর্তমানে অনেক কার্বি খ্রিস্টধর্ম গ্রহণ করেছেন।
উৎসব ও সংস্কৃতি
কার্বিদের প্রধান উৎসব হলো:
👉রঙকের (Rongker): মে-জুন মাসে পালিত কৃষিনির্ভর উৎসব। প্রাকৃতিক দুর্যোগ থেকে রক্ষা ও ভালো ফসলের কামনায় উদযাপিত। নারীরা অংশগ্রহণ করতে পারেন না। বৃহৎ আকারে পালিত হলে একে “রঙকের-পি” বলা হয়।
👉চোমানকান (Chomankan): এটি একটি শ্রাদ্ধানুষ্ঠান, যা আত্মার মুক্তি ও সংসারের কল্যাণে অনুষ্ঠিত হয়, তিনদিনব্যাপী পালিত হয়। নৃত্য, গান, ও সামাজিক মিলন এই উৎসবের অংশ।
👉সমতলের কার্বিরা দোলকাচি, দোমাহি, বীর কিলুট প্রভৃতি অসমীয়া উৎসবেও অংশ নেন।
ভাষা ও উপভাষা
কার্বি ভাষা টিবেটো-বার্মিজ পরিবারের অন্তর্গত। তাদের ভাষার সঙ্গে পুকি-চীন ভাষার মিল রয়েছে। দুইটি উপভাষা প্রচলিত—Rongthak ও Rongber। কামরূপ, মৰিগাঁও এবং খাসি-জয়ন্তীয়া পার্বত্য অঞ্চলের কার্বিরা Rongthak এবং অন্যরা Rongber-এ কথা বলেন। কার্বি ভাষার কোনো নিজস্ব লিপি নেই; সমতলের কার্বিরা অসমীয়া লিপি ব্যবহার করেন।
শাসনব্যবস্থা
কার্বি রাজত্ব তিনস্তর বিশিষ্ট। রাজা হচ্ছেন সর্বোচ্চ নেতা। তার অধীনে থাকে ৯ জন প্রতিনিধি, যাদের নিয়ে গঠিত হয় ‘Sonsirkep’। এরা আবার ৩০ জনকে মনোনীত করেন বিভিন্ন প্রশাসনিক ও ধর্মীয় কাজে—যাদের বলা হয় ‘ব্যাংঠালস’। অপরাধমূলক ঘটনায় যেমন স্বগোত্রে বিয়ে হলে, সমাজ শান্তি বিধানের মাধ্যমে শাস্তি আরোপ করে। এর মধ্যে অন্যতম রীতি হলো Sonthongkep অনুষ্ঠান যেখানে মদ, শূকর, হাঁস-মুরগি উৎসর্গ করা হয়।
সমসাময়িক পরিবর্তন ও চ্যালেঞ্জ
আধুনিক সময়ে বন-জঙ্গল ধ্বংস, কৃষির হ্রাস, খ্রিস্টধর্মে ধর্মান্তর এবং ভাষা-সংস্কৃতির বিলুপ্তির আশঙ্কা এই জনগোষ্ঠীর অস্তিত্বের ওপর প্রভাব ফেলছে। তাদের ঐতিহ্যগত হরিণ শিকারের প্রথাও আজ বিলুপ্তপ্রায়।
উপসংহার
কার্বি জনগোষ্ঠী ভারতের উত্তর-পূর্বাঞ্চলের একটি প্রাচীন, সাংস্কৃতিকভাবে সমৃদ্ধ এবং ঐতিহ্যশালী আদিবাসী গোষ্ঠী। তাদের সমাজ-জীবন, ধর্মীয় বিশ্বাস, পোশাক-পরিচ্ছদ, ভাষা ও সাংস্কৃতিক চর্চা আমাদের দেশের জনজাতীয় বৈচিত্র্যের এক অসাধারণ নিদর্শন। এই অনন্য সংস্কৃতিকে সংরক্ষণ ও প্রচার করা আমাদের সকলের দায়িত্ব।
We welcome thoughtful discussions. Comments are moderated for quality