টুসু উৎসব: বাংলার এক অনন্য লোকঐতিহ্য

টুসু উৎসব: বাংলার এক অনন্য লোকঐতিহ্য

Raju Biswas
0

tusu-utsav-celebration.jpg
 

টুসু উৎসব: বাংলার এক অনন্য লোকঐতিহ্য

টুসু উৎসব বা মকর পরব বাংলার অন্যতম প্রাচীন এবং জনপ্রিয় লোকউৎসব। এটি মূলত বাংলার বেশ কয়েকটি গ্রামাঞ্চলে পালিত হয়, বিশেষ করে পশ্চিমবঙ্গের পুরুলিয়া, বাঁকুড়া, ঝাড়গ্রাম এবং পশ্চিম মেদিনীপুর জেলায়। এছাড়াও ঝাড়খণ্ড ও ওড়িশার বিভিন্ন অঞ্চল এই উৎসবের সঙ্গে ওতপ্রোতভাবে জড়িত। টুসু উৎসব শুরু হয় অগ্রহায়ণ মাসের শেষ দিনে এবং শেষ হয় পৌষ সংক্রান্তির পুণ্যলগ্নে।

টুসু: বাংলার লৌকিক দেবী

টুসু এক লৌকিক দেবী, যাকে প্রধানত কুমারী মেয়েরা পূজা করে। টুসুকে সাধারণত কুমারী মেয়ে হিসেবে কল্পনা করা হলেও কোথাও কোথাও তাকে ঘরের বিবাহিত মেয়ের প্রতীক হিসেবেও পূজা করা হয়। এই পূজা ধান উৎপাদন এবং কৃষিভিত্তিক সমাজের শিকড়ের সঙ্গে নিবিড়ভাবে সংযুক্ত। নতুন ফসল ঘরে তোলার আনন্দ ও কৃতজ্ঞতাই এই উৎসবের মূল ভাবনা। টুসুকে ঘিরে তৈরি হয় এক বিশেষ আবেগ, যা বাংলার গ্রামীণ সংস্কৃতির ঐতিহ্যকে সমৃদ্ধ করে।

tusu-utsav-celebration.jpg

 টুসু উৎসব পালনের ধারা

টুসু উৎসব অগ্রহায়ণ সংক্রান্তি থেকে শুরু হয়ে পৌষ সংক্রান্তি পর্যন্ত এক মাস ধরে চলে। এই সময়ে গ্রামের কুমারী মেয়েরা প্রতিদিন সন্ধ্যায় টুসু দেবীর উদ্দেশ্যে পূজা করেন। একটি পাত্রে চালের গুঁড়ো, তুষ, ধান, গোবর, দূর্বা ঘাস, বিভিন্ন রকম ফুল, এবং কাগজের সজ্জা দিয়ে টুসু দেবীর প্রতিমা স্থাপন করা হয়। পূজার সময় চিঁড়ে, গুড়, মুড়ি, ছোলা ইত্যাদি নিবেদন করা হয়।

পৌষ সংক্রান্তির ভোরে টুসু দেবীকে রঙিন চৌডল বা চতুর্দোলায় বসিয়ে গ্রামের মহিলারা দলবদ্ধভাবে গান গাইতে গাইতে নদী বা পুকুরে নিয়ে যান এবং বিসর্জন দেন। টুসু বিসর্জনের পরে মেয়েরা নদীতে স্নান করে নতুন বস্ত্র পরেন। উৎসবের শেষ দিনগুলোতে গ্রামজুড়ে মেলা বসে, চৌডল প্রদর্শনী ও প্রতিযোগিতার আয়োজন হয়।

tusu-utsav-celebration.jpg

 টুসু সংগীত: এক প্রাণময় ঐতিহ্য

টুসু উৎসবের অন্যতম প্রধান আকর্ষণ হল টুসু সংগীত। এই গানগুলি মূলত লোকাচার এবং সামাজিক অভিজ্ঞতার মেলবন্ধন। টুসু গানের মাধ্যমে মেয়েরা তাদের দুঃখ, আনন্দ, ভালোবাসা এবং সামাজিক বিষয়াবলী তুলে ধরেন। অনেক গানে পণপ্রথা, সাক্ষরতা এবং নারীদের প্রতি সহিংসতার বিরুদ্ধে বার্তা দেওয়া হয়।

টুসু সংগীতকে দুই ভাগে বিভক্ত করা যায়: ভণিতাযুক্ত ও ভণিতাবিহীন। ভণিতাযুক্ত গানগুলিতে সাধারণত গায়িকার নাম বা পরিচয় উল্লেখ থাকে। ভণিতাবিহীন গানে মূলত চার চরণের কাঠামো অনুসরণ করা হয়।

টুসু উৎসবের বর্তমান অবস্থা

সময়ের সাথে সাথে টুসু উৎসব অনেক পরিবর্তনের মধ্য দিয়ে গেছে। অনেক জায়গায় এই উৎসব এখন আগের মতো পালিত হয় না। তবে পশ্চিমবঙ্গ, ঝাড়খণ্ড এবং ওড়িশার কিছু অঞ্চলে এই উৎসব আজও জীবন্ত। বিশেষ করে পুরুলিয়ার তুলিন, মুরগুমা ড্যাম, এবং ঝাড়খণ্ডের রাঁচি অঞ্চলে বড় আকারে টুসু উৎসব পালিত হয়।

ঐতিহ্য সংরক্ষণের আহ্বান

বাংলার ঐতিহ্যবাহী টুসু উৎসব কেবল গ্রামীণ সংস্কৃতির নিদর্শন নয়, এটি আমাদের শিকড়ের প্রতি শ্রদ্ধার প্রতীক। আসুন, আমরা সকলে মিলে বাংলার এই অনন্য ঐতিহ্যকে ভবিষ্যৎ প্রজন্মের কাছে পৌঁছে দিই। আমাদের সংস্কৃতি এবং ঐতিহ্যকে ভালোবেসে তা সংরক্ষণ করি। কারণ বাংলার এই চিরন্তন বার্তা—"বারো মাসে তেরো পার্বণ"—আজও আমাদের জীবনের অবিচ্ছেদ্য অংশ।

🌸 বাংলার ঐতিহ্যকে জানুন, বাংলাকে ভালোবাসুন। 🌸

tusu-festival-history-culture

Post a Comment

0Comments

We welcome thoughtful discussions. Comments are moderated for quality

Post a Comment (0)

#buttons=(Ok, Go it!) #days=(20)

Our website uses cookies to enhance your experience. Check Now
Ok, Go it!