😱 জ্বর-রোগের দেবতা জ্বরাসুর: তিন মাথা, নয় চোখ! (একসময় এঁর ভয়ে কাঁপতো বাংলা)

জ্বরাসুর: তিন মাথা, নয় চোখ! বাংলার লোকবিশ্বাসে জ্বর-নিরাময়কারী এই দেবতার

বাংলার পল্লী অঞ্চলে এমন কিছু লৌকিক দেবতার চল আছে, যাঁদের নাম শুনলে প্রাচীন ইতিহাস আর লোক-বিশ্বাসের এক অদ্ভুত মেলবন্ধন চোখে পড়ে। এমনই এক বিচিত্র এবং গুরুত্বপূর্ণ দেবতা হলেন জ্বরাসুর।কিন্তু একসময় এই দেবতাকে ঘিরেই আবর্তিত হতো গ্রামীণ মানুষের নিরাময়ের বিশ্বাস। আসুন, বাংলার এই প্রাচীন আরোগ্য দেবতার কাহিনিতে ডুব দেওয়া যাক।

🔥 জ্বরাসুর কে ছিলেন?

 "কেন মাতা ডাকিলে আমারে।

 দেবী বলে, জ্বরাসুর, আমার বয়ন ধর,

 শীঘ্র ডাক আপন কিঙ্করে। 

দেবীর আদেশ পয়্যা, জুরাসুর ক্রোধ হয়্যা 

ডাকে সবে আপনার দলে।"

 আসল ব্যাপারটা হলো, জ্বরাসুর হলেন দেবী শীতলার (বসন্ত রোগের দেবী) সঙ্গী।কিন্তু মজার কথা,শুধু শীতলার নয়, তাঁকে আরও অনেক গ্রাম-দেবতার পাশেও দেখা যায়: পঞ্চানন্দের মহাপাত্র বা পাঁচুঠাকুরের সহচর রূপে কোন কোন পল্লীতে এঁকে দেখা যায়।অনেক জায়গায় ধর্মঠাকুরের অনুচর হিসেবে।দক্ষিণবঙ্গে তাঁকে আটেশ্বর,দক্ষিণরায় বা বসন্ত রায়-এর পাশেও বসতে দেখা যায়।সবচেয়ে বিস্ময়ের কথা হলো—গ্রামে যখন জ্বর বা বিকার ছড়াত, তখন কিন্তু পূজা হতো শীতলার নয়, আলাদা করে জ্বরাসুরের।পল্লিবিশ্বাস ছিল, জ্বরের প্রকোপের মালিক তিনিই, তাই মহামারির দিনে তাঁর নামে পৃথক উপাচার ও বিশেষ পূজা দেখা যেত।

জ্বরাসুরের পৃথক বা স্বাধীন থান উক্ত দু' জেলায় বহু আছে, ওই সকল থানে ইনি পূর্ণদেবতার মর্যাদা পান, একক পূজিত হন। ভক্তেরা এঁকে সর্বপ্রকার জ্বর রোগের নিরাময়কারী দেবতা বিশ্বাসে পূজা করেন, বয়স্কা নারীরা এর বিশেষ পূজার সময় 'জ্বরাসুরের বার' পালন করেন। 'এর প্রাধান্য বর্তমানে বিশেষ দেখা যায় না। কারণ, কলেরা বা বসন্ত রোগের প্রতি লোকের যতটা ভয়, জ্বর বিকারের বিষয়ে ততটা আশঙ্কা পল্লীবাসীরা এখন করে না। এই জন্য এঁরা পূজার প্রচলন কমে গিয়েছে। আগে খুব ঘটা করে এঁর পূজা হত দোলপূর্ণিমার দিন, এখনও পূজা হয় তবে আড়ম্বর থাকে না। 

 🎨 কেমন দেখতে ছিলেন এই দেবতা?

বৈশিষ্ট্য	বিবরণ
মাথা ও চোখ	তিনটে মাথা, নয়টা চোখ!
হাত ও পা	ছয়টা হাত, আর পা মাত্র তিনটে!
রং	পুরো শরীর ঘন নীল বা কাজলের মতো কালো।
পোশাক	হলুদ রঙের ধুতি, ওড়না আর ছোট জামা পরতেন।
পূজা	তাঁর কোনো মূর্তি সবসময় পাওয়া যেত না। পাথর বা কচ্ছপের মতো দেখতে প্রতীক পূজো করা হতো।

জ্বরাসুরের আকৃতি সুন্দর, তবে বিচিত্র। দেহের রং ঘন নীল, কোন কোন স্থানে গাঢ় কালো কাজলের মত। তিন মাথা, নয়টি চোখ, ছয়টি হাত, পা তিনটি। চুল ও গোঁফ কটা রঙের। তিন মাথার ওপর তিনটি মুকুট, গলায় ও হাতে নানারকম অলঙ্কার। হলদে রঙের ওড়না, ধুতি ও বেনিয়ান্ জাতীয় ছোট জামা পরেন। এঁর কোন বাহন বা প্রহরণ দেখা যায় না। সর্বত্র মূর্তি নেই-প্রতীক রূপে শিলাখণ্ড, ঘট, দু'এক স্থানে বেলে পাথরের কুর্ম মূর্তি পূজিত হয়। এইরূপ কূর্ম প্রতীকের চার ধারে ঘোড়া মূর্তি খোদাই দেখা যায়। মনে হয় ধর্মঠাকুরের প্রভাবে বা ইনি ধর্মঠাকুরের অনুচর বলে এঁর কুর্ম প্রতীকের প্রচলন হয়েছে।

চব্বিশ পরগণা জেলার অরণ্যবহুল অঞ্চলে জ্বরাসুরের স্বাধীন থানে নামহীন একটি বনদেবতাও দু'এক ক্ষেত্রে দেখা যায়। এঁর আকৃতি অতি বীভৎস। কবন্ধ, পেটের উপর মুখ। এঁর পূজা বর্ণ-ব্রাহ্মণরা করেন না। হাওড়া জেলায় দু'এক পল্লীতে চতুর্ভুজ এবং গণেশের আকৃতি জ্বরাসুরও দেখা যায়। তবে সেগুলি জৈন বা বৌদ্ধ মূর্তি হতে পারে।

সিঁদুর প্রলেপের আড়ালে ওইগুলি আদিতে কি ছিল সে বিষয় স্থির ভাবে কিছু বলা যায় না। স্থানীয় লোকদের বিশ্বাস, ওইগুলি জ্বরাসুরের মূর্তি। ঘোড়া বা ঘোড়ার উপর চড়া মনুষ্যমূর্তি ছলন রূপে দিতে ও দিনের বেলায় এঁর পূজায় বাতি জ্বালিয়ে রাখতে দেখা যায়। পল্লীর লোক মানত করে, ছাগ বলি দেয়। অন্যান্য প্রদেশেও জ্বরাসুরের অনুরূপ আরোগ্য দেবতার পূজা হয়। উড়িষ্যাতে 'জ্বর নারায়ণ', দক্ষিণ ভারতে 'মারীডিয়াম্মা'ও রোগ নিরাময়কারী দেবতা (তবে নারী)। পল্লী অঞ্চলের ওঝা (জ্বর বৈদ্য) ও গুণিন্দের জ্বর ছাড়ানো মন্ত্রে জ্বরাসুরের নাম বা দোহাই শোনা যায়।

জ্বরাসুরের পূজায় প্রায় সর্বত্র বর্ণ-ব্রাহ্মণ পৌরোহিত্য করেন। কোন কোন থানে শীতলার পণ্ডিত বা শীতলার সেবায়েতরাও ওই কাজ করে থাকেন। ব্রাহ্মণ্য বিধান অনুযায়ী এঁর পূজা হয়। সাধারণত যে মন্ত্রটি এঁর পূজার ব্যবহৃত হয় তা উদ্ধৃত করছি:

"ও রুদ্রনিশ্বাস-সম্ভূতাং জ্বরং মৃত্যুপ্রদং নৃণাম্।

 ত্রিপদং ত্রিশিরশ্চৈব নবভিলোচনৈ যুতম্। 

কেশাগ্র স্বর্ণসদৃশং কালান্তকযমোপমম্। 

সদৈব ভস্ম নিক্ষেপং রৌদ্রং সংহাররূপিণম্।

বজ্রাধিকনখস্পর্শস্তৃয়মানং সুরিষিভিঃ।
সুরাসুরপিশাচানাং ভয়দং ক্রুররূপিণম্।
এবং ধ্যায়েন্মহাকাল স্বরূপং রক্তশ্মশ্রুলম্।

 

বীজ: আং হ্রীং হুং স্বাহা।
প্রার্থনা: ও আগচ্ছ মে মহারাজ জ্বর তং শিবনির্মিতঃ তস্মাচ্ছরী
            বাগ্মির্গত্য দূরে যাহি মহাবলা।"

বর্ণ-ব্রাহ্মণরা এই ধ্যান-মন্ত্র ব্যবহার করেন, কিন্তু 'শীতলার পণ্ডিত'রা অনেক সময় বাংলা মন্ত্রাদি পাঠ করেন। অধিকাংশ ক্ষেত্রে তাঁরা ব্রাহ্মণেতর জাতি।

যে মন্ত্রগুলি ব্রাহ্মণ পুরোহিত ব্যবহার করেন তার মধ্যে জ্বরাসুরের নাম পূর্ণ ভাবে নেই; এতে জ্বর নামক দেবতারই উল্লেখ দেখা যায়। 'জ্বর' দেবতার উল্লেখ প্রাচীন বৈদিকশাস্ত্র গ্রন্থে ও সংস্কৃত কাব্যে পাওয়া যায়। অনুমান, সেই জ্বর-দেবতা ও আর্যেতর-অসুর জাতির কোন আরোগ্য দেবতা মিশ্রণে 'জুরাসুরের' উৎপত্তি হয়েছে।এ প্রসঙ্গে একটা কথা বলি। 'জ্বর' দেবতার পূজা এখনও মেদিনীপুর জেলার পল্লী বিশেষে দেখা যায়। তবে জ্বরাসুরেরই প্রাধান্য বেশি।

বাংলাদেশে আজও পল্লী অঞ্চলে অসুর বা দৈত্য-দানব প্রভৃতি আর্যেতর সমাজের দেবতার পূজা একেবারে লোপ পায়নি ও ওইগুলির অধিকাংশই আরোগ্য-দেবতা বিশ্বাসে পূজিত হন। এ থেকে অনুমান করা যায়, সম্ভবত এদেশে যখন আর্যরা প্রথম আসেন সে সময় আর্যেতর জাতি-যারা এ অঞ্চলে অধিবাসী ছিলেন, তাঁরা চিকিৎসা শাস্ত্রে বেশ উন্নত ছিলেন, সে জন্যে আর্যরা তাঁদের আরোগ্য দেবতাদের স্বীকার করে নেন। কোন কোন মনীষী বলেন, শিবকে আর্যরা তাঁদের দেবকুলে স্থান দেন তার অন্যতম কারণ শিব আয়ুর্বেদশাস্ত্রের অধিকারী ছিলেন। যে সকল আরোগ্য দেবতাকে (বা লৌকিক-দেবতাকে) এখনও বাংলাদেশের পল্লী অঞ্চলে দেখা যায় তাঁদের অনেকেই আর্যেতর সমাজ থেকে এসেছেন মনে হয়।আলোচ্য জুরাসুর-দেবতার নাম থেকেই ধারণা করা যায় তিনি অসুর কুলের দেবতা।

পঞ্চানন্দকে 'ব্যাধিনামীশ্বর' বলে ভক্তেরা অভিহিত করলেও তিনি দৈত্য বলেও কল্পিত হন। এমন কি ফোঁড়া-খোস-পাঁচড়ার দেবতা ঘণ্টাকর্ণ-যাঁকে 'রক্ষ-রক্ষ মহাবলং' বলে প্রার্থনা করা হয়, তিনি যে পিশাচ এবং বিষ্ণুবিদ্বেষী সে কথা তাঁর মাহাত্ম্য প্রচারের জন্যে রচিত পুঁথিগুলি বা ব্রতকথা থেকে বোঝা যায়।

জ্বর বিকারের নিরাময়ের জন্যে ব্রাহ্মণদানব বা দানো যুক্ত নামের বহু দেবতার পূজা এদেশে এখনও লোপ পায়নি। দানব ও অসুর একই অর্থে ব্যবহৃত হয়। পূর্ববঙ্গে বনদুর্গার সন্তান বলে যে 'বারভাইয়া'র পূজা হয় তা দ্বাদশ দানবেরই পূজা।একটি কথা মনে হয়, এই সব দেবতাগুলির উৎপত্তি বাংলাদেশেই। প্রাচীন বৈদিক-সাহিত্যে ঐতরেয় আরণ্যক প্রভৃতি গ্রন্থে, এদেশের লোকদের অসুর বলে উল্লেখ করেছে দেখা যায়।

 🤔 এখন কি আর তাঁর পূজো হয়?

আগে দোলপূর্ণিমার সময় খুব ধুমধাম করে তাঁর পূজো হতো। গ্রামের মহিলারা বিশেষ 'জ্বরাসুরের বার' পালন করতেন।কিন্তু এখন পরিস্থিতি বদলেছে। এখন আর মানুষ কলেরা বা বসন্তের মতো জ্বরের প্রকোপে অতটা ভয় পায় না। ডাক্তার-বদ্যি বেড়েছে। তাই জ্বরাসুরের সেই জমকালো পূজো এখন প্রায় বন্ধ। তবে এখনো কিছু গ্রামে তাঁর থান বা মন্দির আছে, যেখানে সাধারণ মানুষ আজও ভক্তিভরে তাঁর কাছে প্রার্থনা করে।জ্বরাসুর হলেন সেই দেবতা, যিনি আমাদের মনে করিয়ে দেন—একসময় জ্বরই ছিল মানুষের কাছে সবচেয়ে বড় আতঙ্কের নাম!

📜 অসুর আর বৌদ্ধ প্রভাব! 

বাঁকুড়ার বহু গ্রামে আজও ‘অসুর’ নামের উপস্থিতি—স্মারক যেন সেসব আদিম ওঁরাও-গোষ্ঠীর, যাদের এক শাখা আজও ‘অসুর’ নামে পরিচিত। জ্বরাসুরের আকৃতির সঙ্গে বৌদ্ধ আরোগ্যদেবতা পর্ণশবরী ও যমান্তক / যমারী–র সাদৃশ্য ইতিহাসকে আরও রহস্যময় করে তোলে।তবুও লক্ষণীয়—বৌদ্ধ রূপের অনুরণন থাকলেও, জ্বরাসুরের পূজায় বৌদ্ধাচারের ছাপ নেই।কারণ তাঁর বিশেষ পূজা হয় ফাল্গুন-চৈত্র পূর্ণিমায়, বৈশাখে নয়—যেখানে বৌদ্ধ দেবতার পূজার ক্ষেত্রে বৈশাখী পূর্ণিমাই মুখ্য।