🗿 বারাঠাকুর: বাংলার লৌকিক দেবতা বারাঠাকুর — রহস্যময় মুণ্ডমূর্তি ও লোকায়ত ধর্মের বিস্ময়(মুণ্ডমূর্তি)

(মুণ্ডমূর্তি) বারাঠাকুর: রহস্যময় মুণ্ডমূর্তি ও বাংলার লোকায়ত ধর্ম

 মাঘ মাসের প্রথম দিনে পশ্চিমবঙ্গের দক্ষিণতম অংশে যে দেবতা পূজিত হন, তাঁর নাম বারাঠাকুর (মুণ্ডমূর্তি)। পূর্ণ মূর্তি নয়, বরং ঘটের মতো মুণ্ডমূর্তি রূপে পূজিত এই দেবতা বাংলার লোকসংস্কৃতিতে আজও এক গুরুত্বপূর্ণ স্থান দখল করে আছেন।

🤯 মুণ্ডমূর্তির স্বরূপ ও আকার

বারাঠাকুরের পূজা হয় প্রায়শই একজোড়া মুণ্ডমূর্তির মাধ্যমে, যা 'বারা' নামে পরিচিত।

আকৃতি: এই মুণ্ডমূর্তিগুলি দেখতে অনেকটা ঘটের মতো হলেও কিছু পার্থক্য আছে। ঘটের উপর দিকে এক অংশ উঁচু করে পাতার আকৃতিতে বাড়ানো হয়, যা দেবতার মুকুট হিসেবে বিবেচিত।

সজ্জা: মুকুটের উপর বনের লতাপাতা ও ফুল আঁকা থাকে। মুকুটের ঠিক নীচে বা ঘটের গোলাকার অংশে চোখ, মুখ, কান ইত্যাদি উৎকীর্ণ ও আঁকা হয়।

উৎসবের সময়: মাঘ মাসের প্রথম দিনে (মকর সংক্রান্তির কাছাকাছি) চব্বিশ পরগণা, হাওড়া এবং আরও দু-একটি জেলায় বারাঠাকুর পূজার প্রচলন আছে।

🏞️ লোকশিল্পের স্রোত: চব্বিশ পরগণার দক্ষিণ অংশে এই পূজার ব্যাপকতা এতটাই যে, মনে হয় না পল্লীসমাজে লৌকিক দেবতার মর্যাদা এতটুকু কমেছে। এই উপলক্ষে কুচল-কুমাররা হাজার হাজার জোড়া বারা মূর্তি তৈরি করেন, যা আদি লোকশিল্পের ধারা বহন করে চলেছে।

🏛️ শাস্ত্রীয় স্থানহীন, তবুও সার্বজনীন

বারাঠাকুর শাস্ত্রীয় দেবতা নন, কিন্তু তাঁর পূজায় এক বিশেষ সমন্বয় লক্ষ্য করা যায়:

 পৌরোহিত্য: প্রায় সব ক্ষেত্রেই বর্ণ ব্রাহ্মণ পৌরোহিত্য করেন এবং শাস্ত্রীয় বিধানও অনুসরণ করা হয়।

 স্থানের বৈশিষ্ট্য: ব্রাহ্মণ-শাসিত সমাজ একে স্বীকার করলেও শাস্ত্রে স্থান না পাওয়ায়, এঁর পূজা হয় বাসস্থান থেকে পৃথক জায়গায়—যেমন খোলা মাঠে, গাছের তলায় বা জলাশয়ের ধারে।

পূজা ও বিসর্জন: বারাঠাকুর বছরে মাত্র একদিন পূজা পান এবং তাঁর মূর্তি

দেবতার পরিচয়: দক্ষিণরায় ও নারায়ণী , ব্রাহ্মণ পুরোহিত এবং স্থানীয় জনসাধারণের বিশ্বাস অনুযায়ী, এই যুগ্ম বারার প্রতীকী পরিচয় রয়েছে: 

বারা মূর্তি	প্রতীকী দেবতা	সম্পর্ক ও বিশ্বাস
প্রথম বারা	ব্যাঘ্র দেবতা দক্ষিণরায়	শিবানুচর বা শিবপুত্র।
দ্বিতীয় বারা	নারায়ণী	দক্ষিণরায়ের মা।

 উৎপত্তি কেন্দ্র: দক্ষিণ চব্বিশ পরগণা দক্ষিণরায় পূজার উৎপত্তি কেন্দ্র হওয়ায়, এই অঞ্চলে বারাঠাকুর এমন সার্বজনীন হয়েছে। 

  অন্য বিশ্বাস: অনেকের বিশ্বাস, বারা হলো দক্ষিণরায়ের কাটা মুণ্ড। যদিও 'বারা' শব্দের অর্থ সাধারণত ঘটই বোঝায় (যেমন মনসা, শীতলা, চামুণ্ডা, চণ্ডীর ঘট), কিন্তু দক্ষিণরায়ের প্রাধান্যের কারণে এই অঞ্চলে 'বারা' বলতে 'দক্ষিণরায়ের বারা'কেই বোঝায়।

• 👥 যুগ্ম বারার বৈচিত্র্য ও রহস্য

  একসঙ্গে দুটি বারার পূজা প্রচলিত হলেও এর দুটি রূপ দেখা যায়:

  ১.নর-নারী যুগ্ম বারা (দক্ষিণরায় ও নারায়ণী)

   বৈশিষ্ট্য: একটিতে পুরুষের (নর) এবং অন্যটিতে নারীর (নারী) মুখ আঁকা থাকে।
   আঁকার বিশেষত্ব: নর মূর্তিটির মুখে গোঁফ ও গালপাট্টা থাকে। কিন্তু নারীটির মুখে গোঁফ না থাকলেও গালপাট্টা দেখা যায়।
   রহস্য: গবেষকদের মতে এই অস্বাভাবিক গালপাট্টা রহস্যময়। এটি ইঙ্গিত করে যে হয়তো এই দেবী আদিম কোনো কৌম পুরুষ দেবতার স্বরূপ বজায় রেখেছেন, যিনি পরবর্তীকালে তান্ত্রিক দেবী বা দক্ষিণরায়ের মা রূপে স্থান পেয়েছেন।

দুই পুরুষ যুগ্ম বারা (দক্ষিণরায় ও কালুরায়/কাল গাজী)

বৈশিষ্ট্য: এই যুগ্ম বারার দুটিতেই ..

 বিশ্বাস: সাধারণের বিশ্বাস, এর একটি দক্ষিণরায়ের এবং অপরটি

 সুন্দরবনে: জঙ্গল ও নদীনালা বেশি যেখানে, সেখানে জোয়ারের জল এড়াতে বারাকে বড় গাছের শাখা বা গুঁড়ির উপরে স্থাপন করা হয়। যে গাছে বারা রাখা হয়, তার সবচেয়ে উঁচু শাখায় একটি লাল রঙের নিশান টাঙিয়ে দেওয়ার রীতি আছে।

⚔️ বারা: কাটা মুণ্ড না আকৃতিভেদ?

বারাঠাকুরের উৎপত্তি নিয়ে কবি ও গবেষকদের মধ্যে ভিন্ন মত রয়েছে:

কবি কৃষ্ণরাম দাস (রায়মঙ্গল): তিনি দক্ষিণরায় ও বড়খাঁ গাজীর যুদ্ধের বর্ণনা দিয়ে বলেছেন, বড়খাঁ গাজীর খাঁড়ার আঘাতে দক্ষিণরায়ের মায়ামুণ্ড মাটিতে পড়ে। সেই কাটা মুণ্ডই বারা রূপে পূজিত হয়।

কবি হরিদেব (রায়মঙ্গল): তিনি বারাকে গণেশের মুণ্ড বলে বর্ণনা করেছেন, যা দক্ষিণে পড়ে দেবতা হয়েছিল। দক্ষিণ অঞ্চলে এই বিশ্বাসও প্রচলিত এবং গণেশের ধ্যানেও বারাঠাকুরের পূজা হয়।

🧐 গবেষকদের অনুমান: বারা দক্ষিণরায়ের আকৃতিভেদ হতে পারে না। কারণ দক্ষিণরায়ের মূর্তি সুশ্রী এবং পূজাচারে বারাঠাকুরের সঙ্গে মিল নেই। বারার উগ্র দর্শন এবং মুকুটে বন্য লতাপাতা আঁকা, মন্দির বা থানে নিয়মিত পূজিত না হওয়া, এগুলি তাঁর আদিম কৌম পুরুষ দেবতা হওয়ার দিকে ইঙ্গিত করে।

📜 'বারা' শব্দের ব্যুৎপত্তি

'বারা' শব্দটির একাধিক অর্থ এবং ঐতিহাসিক যোগসূত্র রয়েছে: 

উৎস/অর্থ	তত্ত্ব	সমর্থন
সাধারণ অর্থ	ঘট	মনসা বা শীতলার ঘটকেও 'বারা' বলা হয়।
উঁচু বেদী	চারদিকে ঘেরা একটু উঁচু বেদীকে 'বারা' বলা হয়।	জাঁতাল পূজার কালে খেজুর গাছের ডাল দিয়ে ছোট বেদী ঘিরে রাখা হয়।
সাঁওতাল-মুণ্ডা ভাষা	'বারেয়া' (অর্থ: দুই) শব্দ থেকে 'বারা' আসতে পারে।	সাঁওতাল-মুণ্ডারা আর্যপূর্ব যুগে এই দেশে বাস করত।
প্রণামীর আধার	যুগ্ম বারার একটি প্রতীক, অপরটি প্রণামীর আধার (Ceremonial Container)।	যুগ্ম পূজা প্রথার আদিমত্বের প্রমাণ মেলে।
পানপাত্র	বৈদিক সোমপাত্র বা তান্ত্রিক শ্রীপাত্র (পানপাত্র)।	গবেষকদের কেউ কেউ এই মত দেন।
দ্বারা শব্দ	দক্ষিণদ্বারের 'দ্বারা' > 'বার' > 'বারা'।	চব্বিশ পরগণায় 'বারাসাত', 'বারাতলা'-এর মতো বহু গ্রামের নাম রয়েছে।
প্রাচুর্য	'বারাসাত' শব্দটির প্রাচুর্য অর্থে ব্যবহার।	বিঘ্ননাশের ও প্রচুর ঐশ্বর্যের কামনা করে আদিম যুগে 'বরাম' বা 'বারা পূজা' প্রচলিত হয়। ধানের মরাই সম্পর্কেও এই শব্দ প্রযুক্ত হয়।

 🔎 প্রাগৈতিহাসিক যোগসূত্র

বারাঠাকুরের আদিমত্বের প্রমাণ মেলে প্রত্নতাত্ত্বিক নিদর্শনেও:

মহেঞ্জোদারো: মহেঞ্জোদারো থেকে প্রাপ্ত একটি ক্ষুদ্রাকৃতির পোড়ামাটির মূর্তি দেখতে অনেকটা বারার মতো, এমনকি মুকুটের গঠনের দিক থেকেও মিল আছে।

হরিনারায়ণপুর: চব্বিশ পরগণার হরিনারায়ণপুরে নব্য প্রস্তর যুগের নিদর্শনের সঙ্গে একটি মাটির মূর্তি পাওয়া গিয়েছে, যার সঙ্গে বারার বেশ সাদৃশ্য।

🗿 এই প্রাগৈতিহাসিক মূর্তিগুলি বারাঠাকুরের আদিরূপ (প্রোটোটাইপ) হতে পারে বলে অনুমান করা হয়, যদিও নিশ্চিতভাবে কিছু বলা যায় না।

---