🌿 বাংলার বনরক্ষক ও অপদেবতা 'আটেশ্বর' (আট-মুনসী): কাঁটা-মুগুর হাতে এক লুপ্ত-প্রাধান্য লৌকিক দেবতা

আটেশ্বর দেবতার প্রাচীন মূর্তি, কাঁটা-মুগুর হাতে বলিষ্ঠ রূপ বা তাঁর প্রতীকী থান।

 'আটেশ্বর', 'আট' বা 'আট-মুনসী' হলেন বাংলা দেশের পল্লী অঞ্চলের একটি প্রায় লুপ্ত-প্রাধান্য লৌকিক দেবতা। বর্তমানে ইনি চব্বিশ পরগণা জেলার সুন্দরবন অঞ্চল ও মেদিনীপুরের কাঁথি মহকুমার কিছু পল্লীতে কোনোমতে অস্তিত্ব বজায় রেখেছেন—কোথাও বনদেবতা হিসেবে, আবার কোথাও ভয়ঙ্কর অপদেবতা হয়ে।

চব্বিশ পরগণার পল্লী অঞ্চলের বিশ্বাস অনুযায়ী, আটেশ্বর হলেন অরণ্যরক্ষক ও পশুদের দেবতা। সুন্দরবনে যাতায়াতকারী শিকারী, মৌলে, বাউলিয়া বা আবাদকারী চাষিরা বনে প্রবেশ করার আগে দক্ষিণরায় ও বনবিবির মতো আটেশ্বরকেও পূজা করেন। আটেশ্বরের পুরোনো থানগুলো দেখলেই বোঝা যায়, বর্তমানে তাঁর প্রাধান্য কমলেও একসময় তা বেশ বেশি ছিল। 

আটেশ্বরের রূপ ও প্রতীক: বলিষ্ঠ আদিমতা থেকে রাজবেশ 

আটেশ্বরের বিভিন্ন মূর্তি ও প্রতীক পূজা হয়। তাঁর প্রাচীন রূপটি আদিম ভাবাপন্ন হলেও বলিষ্ঠ ছিল।

• প্রাচীন মূর্তির বর্ণনা:

  বর্ণ ও বেশ: ফিকা নীল বা সবুজ বর্ণ। মাথায় সাধারণ পাগড়ি, বড় বড় বারী চুল এবং হলদে রঙের ছোট কাপড় মল্লের মতো পরা।

  অস্ত্র: তাঁর ডান হাতে খাঁজ কাটা ও কাঁটা বসানো একটি মুগুর থাকে, যা 'কাঁটা-মুগুর' বা 'ঝাঁটা-মুগুর' নামে পরিচিত। (সুন্দরবনের বাঘশিকারীরা এখনও শিকারে এমন মুগুর নিয়ে যান)।

  সজ্জা: কানে মাকড়ি, হাতে বালা, গলায় হার, বড় বড় চোখ ও বিরাট গোঁফ—তবে দাড়ি নেই।

   উন্নত পল্লীর রূপ: অপেক্ষাকৃত উন্নত পল্লীতে আটেশ্বরের রাজবেশ দেখা যায়, যা পৌরাণিক দেবতাদের মতো। রাজবেশ হলেও তাঁর ডান হাতে ছোট গদাটি সর্বদা থাকে, তিনি অন্য অস্ত্র ব্যবহার করেন না।

  মেদিনীপুরে প্রতীক পূজা: মেদিনীপুরে আটেশ্বরের কোনো মূর্তি নেই। এ জেলার মানুষের বিশ্বাস, আটেশ্বর গাছে থাকেন। তাই তারা আটেশ্বরের প্রতীক হিসাবে সেই সব গাছকে পূজা করে।

২. অঞ্চলভেদে বিশ্বাস: রক্ষক বনাম অপদেবতা (H2)

আটেশ্বরের প্রতি মানুষের ধারণা স্থান ও সংস্কৃতিভেদে ভিন্ন।

ক. মেদিনীপুর অঞ্চলের ভয়ঙ্কর বিশ্বাস (H3)

মেদিনীপুরের কয়েকটি পল্লীতে আটেশ্বর সম্পর্কিত ধারণাগুলি অতি ভয়াবহ।

অশরীরী অপদেবতা: আটেশ্বর বা আট-মুনসী আসলে অশরীরী অপদেবতা, কিন্তু তিনি নাকি মাঝে মাঝে মানুষের দেহ ধরে পল্লীর কিছু লোকের সঙ্গে দেখা করেন। এর ফলে লোকের খুব জ্বর, ব্যাধি হয়, এমনকি জীবনহানিও ঘটে।

'কোয়াট' (নিশির ডাক): কাঁথি অঞ্চলে আটেশ্বরের ডাককে 'কোয়াট' বলা হয়। আট নাকি মাঝরাতে গৃহস্থের বাড়িতে গিয়ে যার উপর রাগ আছে, তাকে ডাকে। এই ডাক শুনে কেউ সাড়া দিলে বা ঘরের বাইরে এলে সে দুরারোগ্য ব্যাধিতে ভুগে দু-এক দিনের মধ্যেই মারা যায়।

অন্যান্য বিশ্বাস: মেদিনীপুরের দু-এক স্থানে 'কন্ধকাটাকে'ও 'আট' বলা হয়। কোনো কোনো পুকুরে আটের অধিষ্ঠান থাকে বলে জেলেরা মাছ ধরার আগে পিঠা নৈবেদ্য দিয়ে পূজা করে।

খ. চব্বিশ পরগণা ও সুন্দরবন: পশুরক্ষক দেবতা  

চব্বিশ পরগণা জেলায় আট বা আটেশ্বরের প্রতি এ-জাতীয় ভয়াল ধারণা নেই।

রক্ষকের ভূমিকা: এখানকার মানুষের ধারণা, এই দেবতা তাদের এবং তাদের পোষা গরু, ছাগল প্রভৃতি গৃহপালিত পশুকে বনের হিংস্র জানোয়ারের হাত থেকে রক্ষা করেন। রাত্রে ইনি গ্রাম পাহারা দেন।

পশুরোগে পূজা: গৃহপালিত পশুর রোগ হলে আটেশ্বরের পূজা দেওয়া হয়। অনেকে তাঁদের গরু-ছাগলের প্রথম দোয়ানো দুধ নিজেরা না খেয়ে আটেশ্বরের ভোগের জন্য থানে দিয়ে আসেন।

আট-মাকাল পূজা: এই জেলার জেলেদের পল্লীতে আটেশ্বরের সঙ্গে অপর লৌকিক দেবতা 'মাকালের' স্তূপ প্রতীক পূজা হয়, যেখানে জেলেরা পুরুতের কাজ করেন।

৩. পূজা পদ্ধতি ও ব্রাহ্মণ্য আভিজাত্য 

আটেশ্বর বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই একা স্বাধীনভাবে তাঁর থানে থাকেন, হয় মল্লবেশে না হয় রাজবেশে।

পূজার দিন: শনি ও মঙ্গলবার এঁর পূজার প্রশস্ত দিন।

ভোগ: নিরামিষ নৈবেদ্য দেওয়া হয়। তবে কোনো কোনো থানে প্রতি পূজায় একটু গাঁজা দেওয়ার রীতি আছে। ভোগ নিবেদনের পর থানের সকলে কিছুক্ষণের জন্য অন্যত্র চলে যান।

আভিজাত্য ও শিবের স্থান: আটেশ্বরের প্রাধান্য কিছুটা হ্রাস পেলেও তাঁর আভিজাত্য বজায় আছে। অনেক পল্লীবাসী তাঁকে দক্ষিণরায়, পঞ্চানন্দ বা ধর্মঠাকুরের সমান স্তরের দেবতা মনে করে 'আটেশ্বর শিব' বা শিবের আকৃতি ভেদ মনে করেন।

ব্রাহ্মণ্য বিধান: উন্নত পল্লীর থানে বর্ণ-ব্রাহ্মণরা এঁর পূজা করেন। পূজায় ব্রাহ্মণ্য বিধান অনুসরণ করা হয় এবং সংস্কৃত মন্ত্রও ব্যবহৃত হয়।

উদাহরণ: "আটেশ্বর মহাকায় শ্যামবর্ণ সনাতন। মহিষবাহনং দেব হস্তমুদার বিরাজিত। প্রসন্নং বদনং দেব আটেশ্বর বরপ্রদম্।" (তবে মহিষ বাহন আটেশ্বর বর্তমানে আর দেখা যায় না)

৪. প্রাচীন কাব্যে ও মন্ত্রে আটেশ্বরের উপস্থিতি 

 আটেশ্বরের প্রাধান্য কিছুটা হ্রাস পেলেও তাঁর আভিজাত্য বজায় আছে। অনেক পল্লীবাসী তাঁকে দক্ষিণরায়, পঞ্চানন্দ বা ধর্মঠাকুরের সমান স্তরের দেবতা মনে করে 'আটেশ্বর শিব' বা শিবের আকৃতি ভেদ মনে করেন।আটেশ্বরের উল্লেখ কিছু প্রাচীন মঙ্গলকাব্যে এবং পল্লী অঞ্চলের ওঝা (বিষবৈদ্য)-দের মন্ত্রে পাওয়া যায়।

'কালুরায় মঙ্গল': এই কাব্যে আটেশ্বর, ব্যাঘ্রদেবতা দক্ষিণরায় ও কালুরায়ের সহচর বা পরামর্শদাতা এবং বনের পশুদের রক্ষণাবেক্ষণকারী হিসেবে বর্ণিত। দক্ষিণরায় মানব সমাজে পূজা লাভের ইচ্ছুক হয়ে আটেশ্বরকে জিজ্ঞাসা করেছিলেন: "উপদেশ বল আট যাব কোথাকারে। কোন ছলে লব পূজা কে পূজিবে মোরে।অন্যস্থানে বলা হয়েছে: "ভবানী ভেড়া এই এনেছি ভারতে। আটনামে মুন্সী আছে, সর্বদা রক্ষিতে।

ওঝাদের মন্ত্র: শ্রীঅক্ষয় কয়ালের সংগৃহীত ওঝাদের মন্ত্রে আটের উল্লেখ আছে: "আটের মনুষ্য ছাড় বাও ছাড়ে বাত।"।

৫. গদার সাদৃশ্য ও নামের ব্যুৎপত্তি: আর্যপূর্ব সংযোগ 

বাঁকুড়া, মেদিনীপুর, বীরভূম প্রভৃতি জেলার আদিবাসী লোধা-সাঁওতালদের ভৈরব, কুদ্র, বড়ামের মতোই আটেশ্বর একজন বনদেবতা। তিনি শহরে বা উন্নত পল্লীতে একেবারেই থাকেন না।

ত্রিপুরার 'বুরাশা': ত্রিপুরার বনদেবতা 'বুরাশা'-র সঙ্গে আটেশ্বরের খুব মিল রয়েছে। বুরাশার হাতেও আটেশ্বরের গদার মতো খাঁজ কাটা (Grooved) গদা থাকে। এই ধরনের গদা প্রাগৈতিহাসিক যুগের Grooved hammer-এর নিদর্শন হতে পারে।

'আট' শব্দের অর্থ: আট শব্দের সংখ্যাগত অর্থের সঙ্গে এই দেবতার নামের কোনো সম্পর্ক নেই।

উঁচু জমি (দমদমা): সুন্দরবনের কিছু লোক বলেন, 'আট' মানে উঁচু জমি। দেবতা উঁচু জমিতে বসে সবদিক দেখেন, তাই তাঁকে 'আট' বলে।

বন: 'আট-ঘাট বাঁধা' কথাটির ইঙ্গিত দেয় যে, 'আট' শব্দে বন বোঝাতো। পল্লীর লোকেরা বন ও নদী নিয়ে সাবধান থাকত, তাই বলতেন 'আটঘাট বেঁধে চলবে'। সেখান থেকেই বনের দেবতার নাম হয় 'আট' দেবতা, যা পরে সংস্কৃত ভাষার প্রভাবে 'আটেশ্বর' হয়েছে।

সর্পদেবতা: এক জাতের সাপকে 'আট' বলা হয়। নীল বা ঘন সবুজ রং, হাতে মুগুর এবং জলাশয়ের ধারে ঝোপ-ঝাড়ে থাকা—এগুলি সর্পদেবতার কয়েকটি লক্ষণ হতে পারে।

---

উপসংহার: আটেশ্বর বাংলার লোকায়ত ধর্মবিশ্বাসের এক জটিল চরিত্র, যিনি একদিকে গ্রাম ও পশুদের রক্ষক, আবার অন্যদিকে ভয়ংকর অপদেবতা হিসেবে মানুষের মনে স্থান করে নিয়েছেন।