সত্যনারায়ণ সত্যপীর: বাংলার লোকদেবতার সমন্বয়, উৎপত্তি এবং পূজার নিয়ম

সত্যনারায়ণ সত্যপীর: বাংলার লোকদেবতার সমন্বয়, উৎপত্তি এবং পূজার নিয়ম

লালপেঁচা.in – বাংলার না-বলা কথা
0

সত্যনারায়ণ বা সত্যপীর পূজার্চনা উপাসনা ভারতের বিভিন্ন অংশে অনেক অনেক হিন্দু ও মুসলমান ধর্মাবলম্বীদের মধ্যে প্রচলিত আছে বহু শতাব্দী হতে। বাংলা, বিহার, উড়িষ্যা প্রদেশের প্রায় সর্বত্র এবং পাঞ্জাবের জলন্ধর ও দাক্ষিণাত্যের মহীশূর অঞ্চলে এর প্রাধান্য লক্ষিত হয়।
জানা যায়-মহাভারতে সত্যনারায়ণের অনুরূপ দেবতা-সত্যবিনায়ক এবং স্কন্দ পুরাণের রেবাখণ্ডে সত্যনারায়ণ দেবতার উল্লেখ কিছু কিছু আছে। বাংলার মুসলমান সমাজের উপাস্য-সত্যপীর ও ভক্ত সত্যনারায়ণ অনুরূপ দেবতা 'সত্যদেব' বাংলার নাথ যোগী জাতির উপাস্য দেবতাদের অন্যতম।
মহারাষ্ট্রের প্রায় প্রত্যেক হিন্দুর গৃহে সত্যবিনায়ক দেবতার পূজা হয়ে থাকে। কিন্তু মহাভারতে বর্ণিত সত্যবিনায়ক বা স্কন্দ পুরাণে উল্লিখিত সত্যনারায়ণ পূজার্চনা বা পূজার বিধি-বিধান ভক্তজনের ধারণা-বিশ্বাসের সঙ্গে বর্তমানকালে (বা গত কয়েক শতাব্দী হতে) ব্যাপক প্রচলিত সত্যনারায়ণ পূজার্চনায় পার্থক্য দেখা যায় এবং শাস্ত্রীয় অপেক্ষা যে সকল লোকায়ত বা শাস্ত্রেতর বিধানের প্রাধান্য লক্ষিত হয়, সেগুলি থেকে ধারণা আসে যে, সত্যনারায়ণ পূর্ণ ভাবে শাস্ত্রীয় দেবতা বা প্রাচীন যুগীয় না হতেও পারেন। একেবারে অনুরূপ মুসলমান সমাজের সত্যপীরে বেলায় একই মন্তব্য করা যেতে পারে। লোকায়ত বিধানে এবং ভিন্ন পরিবেশে পূজিত বা উপাসিত হলেও সত্যনারায়ণ ও সত্যপীর মূলত একই উপাস্য বহু গবেষক সেরূপ মন্তব্য করেছেন। দুই সমাজের দুই উপাসিত দেবতার সমন্বয় বা অভিন্নতার এবং উৎপত্তির বিষয় এ প্রবন্ধে অন্যতম আলোচ্য।
লৌকিক দেবতা বিষয়ে কোন কোন গবেষক মন্তব্য করেছেন-সত্যনারায়ণ পূজা আদি মধ্য যুগে পরিকল্পিত হয় এবং এদেশে হিন্দু সমাজের মধ্যে প্রচলিত থাকে; পরে ভারতে মুসলমান অধিকারের পর, সে পূজার্চনা পল্লীর ধর্মান্তরিত মুসলমান সমাজের লোকেরা, জন্মগত বা বংশগত সংস্কারের প্রভাবে গ্রহণ করেন, কিন্তু তাঁরা, অত্যধিক নিষ্ঠাবান মোল্লা মৌলভির আপত্তির বা বিরক্তির আশঙ্কায় সত্যনারায়ণের 'নারায়ণ' পরিবর্তে 'পীর' শব্দ যুক্ত করে সত্যপীর নাম করে নেন, ফলে জনপদ সমাজে সকল শ্রেণীর মুসলমানের সত্যপীর উপাসনায় কোন শংকা থাকে না। তবে এটা অনুমান মাত্র। কালক্রমে নামের দিক থেকে কিছু ভিন্ন, দুই সম্প্রদায়ের মধ্যে পৃথক পরিবেশে ও প্রথায় পূজা বা উপাসনা অনুষ্ঠিত হলেও আদি ধারা লুপ্ত হয় না, সে কারণ সত্যনারায়ণ বা সত্যপীর পূজার্চনায় ভক্তদের স্ব স্ব উপাস্যের প্রতি ধারণা বিশ্বাস বিভক্ত হয়নি। সে কারণ একটি উপাস্যের সঙ্গে অপরটি বহু দিক হতে মিল দেখা যায়। মধ্য যুগে হিন্দু মুসলমান উভয় সম্প্রদায়ের কবিদের রচিত সত্যনারায়ণ বা সত্যপীরের মাহাত্ম্য বিষয়ক কাব্য বা পাঁচালীগুলির মধ্যে সত্যনারায়ণ ও সত্যপীর অভিন্ন বলে প্রচার থাকে। এ সকল দিক থেকে বিশ্লেষণ করলে ধারণা হতে পারে-সত্যনারায়ণ ও সত্যপীর আদিতে যাই থাকুন বর্তমানে গত কয়েক শতাব্দী বা মধ্যযুগ হতে হিন্দু ও মুসলমানদের একটি সমন্বিত দেবতা।

(নিষ্ঠাবান উচ্চ বর্ণের হিন্দু সমাজে শাস্ত্রজ্ঞ ব্রাহ্মণ পুরোহিত দ্বারা সত্যনারায়ণের (বিষ্ণুর) শালগ্রাম প্রতীকে এবং সংস্কৃত ভাষায় রচিত ধ্যান মন্ত্রে পূজা অনুষ্ঠিত হয়ে থাকে, পুরোহিতরা প্রচার করেন-বিষ্ণু ও সত্যনারায়ণ অভিন্ন, কিন্তু পুজার নৈবেদ্যের মধ্যে শিরনি ও পাঁচটি মোকাম এবং প্রতীকের আসনের উপর একটি ক্ষুদ্রাকৃতি লৌহ অস্ত্র রাখা আবশ্যিক রীতি বা বিধান দেখা যায়। হিন্দুদের কোনও শাস্ত্রীয় বা লৌকিক দেবতার পূজায় শিরনি বা মোকাম নৈবেদ্য রূপে থাকে না বা দেবতার মূর্তি-প্রতীকের আসনের উপর কোন অস্ত্রও রাখার রীতি নেই। উপাস্যের উদ্দেশ্যে শিরনি বা মোকাম উৎসর্গ করা সম্পূর্ণ মুসলমানি প্রথা। 'শিরনি' ও 'মোকাম' দুটিই ফারসী শব্দ।

সত্যনারায়ণ পূজায় হিন্দু শাস্ত্রীয় বিধানে ধ্যান-মন্ত্র-আবৃত্তি ও আরতি অন্তে পূজার অঙ্গ হিসাবে পুরোহিতগণ, সত্যনারায়ণ দেবতার যে মাহাত্ম্য-প্রচারক কাব্য (পুঁথি) বা 'ব্রত কথা' পাঠ করে থাকেন, তার মধ্যে মুসলমান ফকীরের বা পীরের উল্লেখ শুধু নয়-সত্যনারায়ণ যে পীরের রূপ ধরেছিলেন এবং সত্যপীর ও সত্যনারায়ণ অভিন্ন এরূপ প্রকার থাকে।প্রায় দু'শ বৎসর পূর্বে রচিত শঙ্কর আচার্যের 'সত্যনারায়ণের পুঁথি' হতে কয়েক ছত্র উদ্ধৃত করছি:-

"একদা বৈকুণ্ঠ ধামে চিন্তে নারায়ণ।
মর্ত্যেতে কলহ সকল ধর্মের কারণ।
সকল আপদের সেরা ধর্মের কলহ।
পৃথিবী ভাসিয়ে যায় রক্ত অহরহ।
মিলাতে সকল ধর্ম কামনা আমার।
সত্যপীর রূপে আমি হব অবতার।
ফকিরের বেশে আমি ধরায় যাইব।
নরধর্ম রীতি শিক্ষা প্রচার করিব।
কেহ বা ডাকিবে মোরে সত্যপীর বলি।
পীর আর নারায়ণ একই সকলি।

অষ্টাদশ শতকের 'শিবায়ন' রচয়িতা-কর্ণগড় রাজসভার বিখ্যাত পণ্ডিত-রামেশ্বর ভট্টাচার্য যদিও তিনি স্কন্দপুরাণ অনুসরণ করেছিলেন ও তাঁর কাব্যটির নাম 'সত্যনারায়ণের কথা', তাহলে তিনি বলেছেন-

"সত্য সত্য সত্যপীর সর্ব সিদ্ধিদাতা।
বাঞ্ছা বড় বাড়িল বর্ণিব এব কথা।"
"জয় জয় সত্যপীর, সনাতন দস্তগীর।
দেব দেব জগতের নাথ।"
"কে জানে তোমার তত্ত্ব, তুমি রজঃ তমঃ সত্ব-
তোমার চরণে প্রণিপাত।।"

রাজকবি-রায়গুণাকর ভারতচন্দ্র, নিষ্ঠাবান শাস্ত্রজ্ঞ সুপণ্ডিত ব্রাহ্মণ, তাঁর কাব্যের নাম দিয়েছিলেন 'সত্যপীরের কথা' (বা ব্রতকথা) তিনি লিখেছেন-

"ফকির শরীর ধরি, হরি হৈলা অবতরি,
এক বৃক্ষতলে কৈল স্থান।"

কবি কৃষ্ণহরি দাস, মধ্যযুগের একজন বিখ্যাত সত্যবীরের পাঁচালীকার, তিনি তাঁর কাব্যে সত্যনারায়ণের বিষয় একটি অভিনব কথা বলেছেন, তিনি লিখেছেন, -সত্যনারায়ণ মানুষ ছিলেন-মালঞ্চা নামক স্থানের রাজকন্যার গর্ভে জন্মেছিলেন। সত্যনারায়ণ বাল্যকালে এক স্থান থেকে একটি পুঁথি কুড়িয়ে পেয়ে রাজগুরুকে দেখান। রাজগুরু সত্যনারায়ণকে ওই পুঁথিটির প্রাপ্তিস্থানে রেখে আসবার নির্দেশ দেন ও বলেন, -ওই পুঁথিটি মুসলমানদের ধর্ম কাব্য। হিন্দু উহা পাঠ করলে তার জাতি নষ্ট হয়। গুরুর কথা সত্যনারায়ণ বিশ্বাস করলেন না-

"হাসিয়া কহিছে সত্যনারায়ণ।
নাম নিলে জাতি নষ্ট করে কোন জন॥ 
এক ব্রহ্ম ভিন্ন আর দুই ব্রহ্ম নাই। 
সংসারের কথা (ধাতা) এক নিরঞ্জন গোঁসাই ।।
সেই নিরঞ্জন নাম বিশমোল্লা হয়।
বিষ্ণু আর বিশমোল্লা কভু ভিন্ন নয়।"

সত্যপীর মানুষ হয়ে জন্মেছিলেন অপর একটি পীরের পাঁচালীতেও আছে, উহাতে বলা হয়েছে, সত্যপীর বা সত্যনারায়ণ গৌড়ের সুলতান হুসেন শার কন্যার গর্ভে জন্মেছিলেন। তবে এ জাতীয় প্রচারকগুলির কোন মূল্য নেই একবারে অতিরঞ্জন মাত্র।
এই সকল শিক্ষিত ব্রাহ্মণ কবিদের রচনা থেকে ধারণা করা যায় যে, মধ্যযুগে ১০০ কোটি হিন্দু সমাজেও বিশ্বাস ছিল-সত্যনারায়ণ ও সত্যপীর অভিন্ন বা সমন্বিত দেবতা। খ্রিস্টীয় পঞ্চদশ যোড়শ শতকের মুসলমান কবিদের সত্যপীরের মাহাত্ম্য প্রচার কাব্যেও অনুরূপ বিশ্বাস বা সত্যনারায়ণ ও সত্যপীর অভিন্ন এরূপ প্রচার দেখা যায়।
সত্যপীরের মহিমাকাব্য রচয়িতা মুসলমান কবিদের মধ্যে বিখ্যাত ফয়েজুল্লাহ, ওয়াজিদ আলি তাঁর সত্যপীরের পাঁচালীতে বহুস্থানে 'সত্যপীরের' পরিবর্তে বা উদ্দেশ্যে 'সত্যনারায়ণ' উল্লেখ করেছেন। উক্ত কাব্যের স্থান বিশেষ উদ্ধৃত করা হল:-(বনে ব্যাধেরা শিকার না পেয়ে হতাশ হয়ে, নিজেদের মধ্যে বলাবলি করছে) 

 "সাত রোজ আমরা শিকার না পাই।
বুঝিনু নছিব বুরা চল ঘরে যাই।
হেন কালে দেখা দিলেন সত্যনারায়ণ।
ফকিরে দেখিয়ে তারা ফিরিল তখন।"

(এ কাব্যের নায়ককে শত্রুরা বনের মধ্যে পুঁতে রাখে, কিন্তু সত্যপীরকে স্মরণ করিতে সে মুক্ত হয়, পরে নায়ক ওই মুক্তির কথা বলছে:-

"বনেতে গাড়িয়া আইল আমার কারণ।
বাঁচাইয়া দিল মোরে সত্যনারায়ণ।"

হিন্দুরা বহু দেবতার মূর্তি গড়ে বা প্রতীকে পূজা করতে পারে শাস্ত্রীয় বাধা নেই, কিন্তু মুসলমানদের শরিয়তে আল্লাহ ব্যতীত অপর কারুর উপাসনা করা নিষিদ্ধ, কোরানে পীরবাদও নেই, মুসলমানদের উপাস্যের মূর্তি বা প্রতীক পূজা গর্হিত কর্ম। অথচ দেখা যায়,-বাংলার বহু স্থানে কোন কোন মুসলমান সত্যপীরের (বা অপর পীরগাজী বিবির) প্রতীক-মাটির তৈরি ছোট স্তূপ বা ঢিপি সম্মুখে রেখে উপাসনা করে থাকেন।
বাংলার বিভিন্ন অঞ্চলের পল্লীতে বা উন্নত স্থানে সত্যপীরের একান্ত উপাসক এক শ্রেণীর মুসলমান ফকির দেখা যায় তাঁরা ধর্মমতের দিক থেকে উদার, এবং হিন্দু-মুসলমান উভয় সম্প্রদায়ের ব্যক্তিদের মঙ্গলের উদ্দেশ্যে দরগায় সত্যপীরের আরাধনা করে থাকেন, পল্লীর সকল ধর্মের ও বর্ণের ভক্ত বা বিশ্বাসী রোগীদের রোগের নিরাময় কামনায় সত্যপীরের প্রসাদী 'তেলপড়া', 'জলপড়া', টোটকা বা হাকিমি ঔষধ, কবচ মাদুলী প্রভৃতি বিতরণ করেন। পল্লীতে কোন রোগ মহামারীরূপে প্রাদুর্ভূত হলেও সত্যপীরের উপর বিশ্বাসী হিন্দু-মুসলমান পীরের দরগায় পূজা হাজোত দেন, দরগার ফকীরের দেওয়া পীরের প্রসাদী-বাতাসা এলাচদানা, পল্লীর ব্রাহ্মণরাও গ্রহণ করেন। অন্য কোন পূজাচারে বা প্রসাদ গ্রহণে এরূপ একতা বা উদারতা পল্লীর (বিশেষ করে উষ্ণকোষ্টির) লোকদের মধ্যে দেখা যায় না।

হিন্দু গৃহে অনুষ্ঠিত সত্যনারায়ণ পূজার নৈবেদ্য-শিরনি, খানদানী মুসলমানরা অনেকে গ্রহণ করেন।এ সকল দিক হতে বিশ্লেষণ করলে কয়েকটি ধারণা হয়:-

1।  সত্যনারায়ণ ও সত্যপীর একই উপাস্য। হিন্দুসমাজে যিনি সত্যনারায়ণ তিনিই মুসলমান সমাজে সত্যপীর।

2। সত্যনারায়ণ পূজা হিন্দুসমাজে প্রাচীনকাল হতে প্রচলিত, পরে অর্থাৎ মধ্যযুগে কোন কোন পল্লীর মুসলমানরা ওই পূজা বা উপাসনা গ্রহণ করেন এবং (অতি-নিষ্ঠাবান মোল্লা-মৌলভির বিরক্তির কারণ হতে পারে এই আশংকায়) সত্যনারায়ণের 'নারায়ণ' শব্দের স্থানে পীর শব্দ যুক্ত করে নেন। (এবিষয়ে একটি অভিমত প্রচলিত আছে-গৌড়ের সুলতান হুশেন শাহ তাঁর সময়ে হিন্দু ও মুসলমান প্রজাদের মধ্যে ধর্মীয় একতা সৃষ্টির কামনায় হিন্দুদের সংস্কৃত ভাষার 'সত্য' শব্দ মুসলমানদের আরবী শব্দ 'পীর' মিশ্রিত করে-সত্যপীর পূজাউপাসনা প্রবর্তন করেছিলেন। বর্তমান প্রবন্ধে এ বিষয়টি পরে বিশেষভাবে আলোচিত হয়েছে।)

3। পরিবেশ বিশেষে নামের দিক থেকে ও অপর দু'একটি বিষয়ে কিছু পার্থক্য থাকলেও সত্যনারায়ণ ও সত্যপীর উপাসনা একটি সমন্বিত পূজাচার।
এখন প্রশ্ন হতে পারে, ধর্মাচার সম্বন্ধে রক্ষণশীল দুটি ভিন্ন সম্প্রদায়ের মধ্যে কি কারণে বা কিসের প্রভাবে এই সমন্বয় ঘটা সম্ভব হয়েছিল।
ওই প্রশ্নের উত্তরে কয়েকটি গবেষণালব্ধ অনুমান উপস্থিত করা যায়-

১। ভারতে মুসলমান অধিকারের পর হিন্দুরা স্বধর্ম রক্ষার ব্যাপারে শংকিত হলেও মুসলমান সংস্কৃতির প্রভাব কিছু কিছু হিন্দুসমাজে বিস্তার লাভ করেছিল এবং মুসলমান উদারপন্থী শান্তিপ্রিয়-পীর গাজীদের প্রতি শ্রদ্ধাশীল না হয়ে পারে নি, এইভাবে ধর্মীয় বিষয়ে একটা একতা এসে যায়।
২। নবব্রাহ্মণ্য যুগে বা ওই সময়ের কিছুকাল পরেও অনুন্নত বা নিম্ন বর্ণের হিন্দুরা স্বধর্মী-উন্নত বা উচ্চকোটি সমাজে অবহেলা অমর্যাদা পেতে থাকে, এমন কি হিন্দু হয়েও হিন্দু-শাস্ত্রীয় দেবতার পূজার্চনার অধিকারচ্যুত হয়, ফলে লৌকিক দেবতা বা লোকায়ত ধর্ম ব্যতীত তাদের উপাস্য বা ধর্মাচার রলে কিছু থাকে না, এ সময় পীর গাজীদের উদার বা শ্রেণী ভেদাভেদহীন ধর্ম প্রচারে তাঁদের প্রতি শ্রদ্ধাশীল হন, কিন্তু সকলে স্বধর্ম ত্যাগ না করলেও মুসলমান ধর্মের প্রতি কিছু কিছু আকৃষ্ট হন। ওই সময়ে এদেশে বৌদ্ধধর্ম লুপ্তপ্রায় ও নাস্তিক ধর্ম বলে নিন্দনীয় হলে ভিক্ষুহীন বৌদ্ধরা বা তাঁদের বংশধরগণ, ব্রাহ্মণ শাসিত হিন্দুসমাজে প্রবেশ লাভ করতে পারেনি আগ্রহ থাকা সত্ত্বেও; তাঁরাও সকলে মুসলমান ধর্ম গ্রহণ না করলেও পীর গাজীদের উদার ধর্মমতের প্রতি আকৃষ্ট হন।

আর মুসলমানদের সঙ্গে হিন্দুদের মিলনের আগ্রহ হয়-পল্লীবাসী শান্তিপ্রিয় সাধারণ বা নিম্নবিত্ত সমাজে, তাঁরা উপলব্ধি করেছিলেন-একই দেশে বা পল্লীতে বংশ পরম্পরায় থাকা ব্যক্তিদের মধ্যে বিরুদ্ধভাব রাখা বা হানাহানি করায় লাভবান হয়-উন্নত সমাজের ব্যক্তিরা বা শাসকশ্রেণি, ক্ষতি হয়-নিম্নস্তরের মুসলমানদের। উভয় সম্প্রদায়ের বিজ্ঞরা বা সমাজপতিগণ বুঝেছিলেন, ধর্মের দিক থেকে পার্থক্য থাকায় সে মিলনে বাধার সৃষ্টি হয়ে থাকে। এক্ষেত্রে স্ব স্ব ধর্ম ত্যাগ না করেও ধর্ম ব্যাপারে একটি সমন্বিত মতবাদ গ্রহণ করলে উভয় সম্প্রদায়ের মধ্যে বিরুদ্ধভাব লোপ পেতে পারে।
এদেশে মুসলমানদের মধ্যে অধিকাংশই হিন্দুসমাজ থেকে ধর্মান্তরিত। মুসলমান শাসক বা শাসন কার্যে গোপন সহায়ক নিম্নশ্রেণির ধর্মপ্রচারকদের প্ররোচনায় হিন্দুদের প্রতি বিরুদ্ধভাবাপন্ন হলেও ধর্মান্তরিতরা বংশগত সংস্কার বশতঃ হিন্দুধর্ম বিরোধী সকলেই ছিলেন না। হিন্দুধর্মের মুসলমানরা অনেকে হিন্দুনারী গৃহিণী করেন। ওই সকল হিন্দুকন্যার মাধ্যমে মুসলমান অন্তঃপুরে হিন্দু সংস্কার কিছু প্রভাব বিস্তার করে।

হিন্দুদের সমারোহে পূজাপার্বণ, দেব-দেবীর সুন্দর সুন্দর আকৃতি ও তাঁদের বিষয়ে প্রচারিত গুণাবলী, মুসলমানদের মনে একটা প্রতিক্রিয়ার সৃষ্টি হওয়া স্বাভাবিক ব্যাপার।তবে বিভেদকারী বা শাসকদের সঙ্গে সম্পর্কিত মুসলমান ধর্ম প্রচারকদের জন্য প্রথমে এদেশীয় মুসলমানরা হিন্দুদের সঙ্গে কোন ধর্মীয় ব্যাপারে সমন্বয় সৃষ্টি করতে পারেনি, পরে বা মধ্যযুগে কয়েকটি উদার-ধর্মবাদের বা মিলন প্রয়াসীদের প্রভাবে ও প্রচারে সে বিষয়ে সম্ভব হয়েছিল বহুলাংশে।

ওই বিষয়ে বিবৃত করছি :-

১। মধ্যযুগে বঙ্গে সুফীবাদ ও দরবেশদের প্রচার। ২। কাশ্মীরের মহিলা সাধিকা লাল বাক্যানীর উদার-ধর্মপ্রচার। ৩। শ্রীচৈতন্যদেবের জাতি বর্ণ ও ভিন্নধর্মাবলম্বীদের প্রতি সমভাব। ৪। গৌড়ের সুলতান-হুশেন শাহের হিন্দু ও মুসলমানদের মধ্যে মিলন প্রচেষ্টা। (কিংবদন্তী আছে হুশেন শাহ হিন্দুর 'সত্য' এবং মুসলমানের 'পীর' শব্দ মিশ্রিত করে একটি সমন্বিত ধর্ম প্রবর্তন করেন আচার্য 'দীনেন্দ্রচন্দ্র সেন রচিত 'বৃহৎ বঙ্গ' গ্রন্থে এ-কথা আছে)

৫। বাদশাহ আকবরের উদার 'দীন-ই-ইলাহী' ধর্মবাদ।৬। আগ্রার স্বামিজী মহারাজ ও হুজুর মহারাজ প্রচারিত রাধাস্বামী এবং সন্তবাদ।৭। ধর্মীয় সমন্বয় ব্যাপারে একটি বৈজ্ঞানিক কারণও দেখানো যেতে পারে।'সমাজতত্ত্ব' হতে জানা যায়-যখন দুটি ভিন্ন বা স্বতন্ত্র মানব সম্প্রদায় (বা ধর্মাবলম্বী) প্রথম সংস্পর্শে আসে সে সময় উভয়ের মধ্যে বিরুদ্ধভাব দেখা দেয়, কিন্তু দীর্ঘকাল একত্র ও সমপর্যায় থাকার ফলে তাদেরই মধ্যে আবার আচরণ চিন্তা ভাবনা ও অপরাপর সাংস্কৃতিক দিক থেকে (Domistication of ideas and habits) একটা সমন্বয় Cynchronism of diffusion আপনা হতে গড়ে ওঠে। ধারণা করা যায়-বাংলায় হিন্দু ও মুসলমান সম্প্রদায়ের মধ্যে সত্যনারায়ণ ও সত্যপীর (মুসলমানদের হিন্দু লৌকিকদেবতা পূজা এবং পীরগাজী বিবিদের প্রতি হিন্দুদের ভক্তি শ্রদ্ধা) পূজা-উপাসনা মধ্যে সমন্বয়ের সৃষ্টি হয়েছে এবং বাংলায় তার ফলে-সাহেব ধর্মী, কর্তাৎজা প্রভৃতি ধর্মমতও প্রবর্তিত হয়।

৮। প্রসঙ্গত এই সমন্বয়ের ব্যাপারে আরও একটি বিশেষ কথা বলা যায়-রামানন্দ, কবীর, গণক প্রভৃতি সমাজহিতৈষী ধর্মসংস্কারকদের উদার ও মিলনধর্মী প্রচার উভয় ধর্মাবলম্বীদের অন্তরে এককালে যে প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি করেছিল তা একেবারে লুপ্ত হয়নি পরবর্তীকালেও। ফলে উভয়ের মধ্যে সমন্বয়ের সম্ভব হয়েছিল।

আলোচ্য সমন্বিত ধর্মাচারের উৎপত্তির বিষয় লোকসংস্কৃতি সম্বন্ধে গবেষকদের কয়েকটি মন্তব্য জানা যায়। যথা:-

১। ধর্মঠাকুরের পূজা থেকে সত্যনারায়ণ বা সত্যপীরের পূজার্চনা এসেছে বা ধর্মঠাকুর সত্যনারায়ণে বিবর্তিত হয়েছে।
২। মহাভারত বর্ণিত সত্যবিনায়ক কিংবা স্কন্দপুরাণের রেবাখণ্ডে উল্লিখিত সত্যনারায়ণ পূজার প্রচলন ভারতে পূর্ব হতে ছিল শুধু হিন্দুদের মধ্যে, পরে মুসলমান অধিকারের পর পল্লীসমাজের উদার মতাবলম্বী বা ধর্মন্তরিত মুসলমানরা প্রচলিত বহু লোকায়ত ধর্মাচার এবং সত্যনারায়ণকে স্বীকার করেন, তবে সত্যনারায়ণকে 'সত্যপীর' করে নেন। আদি একই উপাস্য ছিল সে কারণ ভিন্ন পরিবেশে অর্চিত হলে উৎপত্তিতে অভিন্ন থাকায় পরবর্তীকালে ভিন্ন আখ্যা হলেও মিল দেখা যায় ভক্তদের ধারণা বিশ্বাসে বা পূজাচারে।

৩। আদি মধ্যযুগে সাধকপীর-মনুসুর হাল্লাদ সত্যদর্শী ধর্মনেতা ছিলেন, তিনি নিজেকে 'সত্যদর্শী' বা 'সত্য' বলে প্রচার করেন (এ কারণে তিনি স্বধর্মীদের দ্বারা নিহত হন) তাঁর মুরিদ বা শিষ্যগণ তাঁকে 'সত্যপী' আখ্যা দেন এবং তিনি পরে উপাস্য পদে উন্নীত হয়ে যান। তাঁর অনুরাগী বা ভক্তদের প্রচারের ফলে হিন্দু মুসলমান উভয় সমাজে সত্যপীর অর্চনা প্রচলিত হয়।
৪। গৌড়ের স্বাধীন ও উদার মতাবলম্বী সুলতান হুশেন শাহ বাংলার হিন্দু-মুসলমান সম্প্রদায়ের ধর্মীয় মিলন কামনায় হিন্দুদের সংস্কৃত ভাষা 'সত্য' এবং মুসলমানদের ফারসী ভাষা 'পীর' মিশ্রিত করে 'সত্যপীর' পূজা অর্চনার প্রবর্তন করেছিলেন।
প্রসঙ্গতঃ সত্যনারায়ণ বা সত্যপীরের পূজা-উপাসনা এবং মূর্তি বা প্রতীক বিষয়ে কিছু বলা প্রয়োজন: দেবদেবীর মূর্তি-পূজক হিন্দুসমাজেও সত্যনারায়ণের বিশিষ্ট কোন মূর্তি দেখা যায় না। উন্নত বা বর্ণহিন্দু সমাজে ব্রাহ্মণ পুরোহিতরা সত্যনারায়ণ ও বিষ্ণু অভিন্ন বলে প্রচার করে থাকেন এবং সত্যনারায়ণের প্রতীক রূপে (বিষ্ণুর প্রতীক) শালগ্রাম শিলা পূজিত হয়। কিন্তু অনুন্নত কিংবা পল্লীর হিন্দুসমাজে যে সকল স্থানে সত্যনারায়ণ পূজায় পৌরোহিত্য করেন ব্রাহ্মণেতর কোন জাতি, যে সকল ক্ষেত্রে শালগ্রাম শিলা থাকে না, তবে যে প্রতীক থাকে তার বিবরণ দেওয়া হল-কয়েকটি লোহার সরু শিক চার-পাঁচ ফুট লম্বা, সেগুলি একত্র করে ঠিক মাঝ বরাবর দু পাঠ করা হয়, পরে শিকগুলির শেষ অংশ তার দিয়ে বেঁধে সমগ্র অংশ লাল রংয়ের কাপড়ে আচ্ছাদিত করা হয়, ফলে প্রতীকটি দেখতে হয় গদার মত। পল্লীর সত্যনারায়ণের একান্ত পুরোহিতের কাছে এরূপ প্রতীক থাকে, গৃহস্থের বাড়ি সত্যনারায়ণ পূজার সময় পুরোহিতরা ওইরূপ প্রতীকটিকে সেখানে নিয়ে যান। সত্যনারায়ণের ডোম-পণ্ডিত বা পুরোহিতরা, একটি মাটির ছোট ভাঁড় বা পিতলের কলসীর উপর সিঁদুর মাখিয়ে সত্যনারায়ণের প্রতীক করে নেন, ওইরূপ প্রতীকটি একটি থালা বা বারকোষের উপর স্থাপন করে পল্লীর সকল শ্রেণির গৃহস্থদের বাড়ি বাড়ি ভ্রমণ ও সত্যনারায়ণের গান করে থাকেন, পল্লীর বধূরা সত্যনারায়ণের পূজার উদ্দেশ্যে ডোম পুরোহিতের হাতে ভাল ফলমূল পাঁচটি বা সংপায় আশা করে পয়সা দিয়া থাকেন। কোন কোন ডোম পুরোহিতের সত্যনারায়ণ পূজার স্থায়ী থান (বা খড়ে ছাওয়া মাটির মন্দির) থাকে, তার কেন্দ্রস্থলে প্রতীক ঘট স্থাপিত হয়-পল্লীর সকল শ্রেণীর হিন্দু-মুসলমান সেরূপ থানে পূজা দিয়া থাকেন। গৃহস্থের গরুর বাচ্চা হবার পর দুধ বা বাগানের কলা পাকাবার পর একছড়া কলা সত্যনারায়ণের থানে দিয়া আসেন। পল্লী অঞ্চলে এরূপ লোকায়ত বিধান বর্তমানেও কিছু কিছু প্রচলিত আছে।

নিষ্ঠাবান বা শাস্ত্রশাসিত মুসলমান সমাজে উপাস্যের মূর্তি এমনকি প্রতীক পূজা নিষিদ্ধ, তাহলেও পল্লীর লোকায়ত বিধান অনুসরণকারী কোন মুসলমান সমাজে বা সত্যপীরের দরগায় প্রতীক দেখা যায়-একটি পিঁড়ির উপর বৃত্ত এঁকে তার মধ্যস্থলে মাটির একটি ক্ষুদ্র স্তূপ রাখা হয় উহার উপর একটি ক্ষুদ্র লৌহ অস্ত্র বা ছোরা ও ফুলের মালা দেওয়া হয়। সত্যপীরের দরগায় হিন্দু-মুসলমান উভয় সম্প্রদায়ের (ও বর্ণের) ব্যক্তি পূজা হাজোত দিয়া থাকেন। 

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

0মন্তব্যসমূহ

We welcome thoughtful discussions. Comments are moderated for quality

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন (0)

#buttons=(Ok, Go it!) #days=(20)

Our website uses cookies to enhance your experience. Check Now
Ok, Go it!