ভ্রাতৃদ্বিতীয়ায় জঙ্গলমহলে বাঁদনা পরব: কৃষি ও আদিবাসী ঐতিহ্যের প্রাণোৎসব

ভ্রাতৃদ্বিতীয়ায় জঙ্গলমহলে বাঁদনা পরব: কৃষি ও আদিবাসী ঐতিহ্যের প্রাণোৎসব

লালপেঁচা.in – বাংলার না-বলা কথা
0

  

জঙ্গলমহলের প্রাণের উৎসব: বাঁদনা পরবের রঙে ভ্রাতৃদ্বিতীয়া

জঙ্গলমহল আজ উৎসবমুখর। ভ্রাতৃদ্বিতীয়ার দিনটিকে ঘিরে পুরুলিয়া, বাঁকুড়া, ঝাড়গ্রাম ও পশ্চিম মেদিনীপুরের গ্রামেগঞ্জে মেতে উঠেছে মানুষ। সবখানেই এক ঐতিহ্যের টান—বাঁদনা বা বাঁধনা পরব, যা শুধু উৎসব নয়, একে বলা যায় কৃষিজীবী সমাজের জীবনের রক্তপ্রবাহ। কার্তিক মাসের শেষ প্রান্তে এই উৎসব যেন মাটির গন্ধে, গরুর ডাকে, আলোর দীপে এবং গানের তালে তালে প্রাণ পায়।

পরবের ভিত্তি: কৃষি ও প্রাণপ্রেমের মিলন

বাঁদনা পরবের শিকড় মাটির খুব গভীরে। এটি এমন এক উৎসব যেখানে কৃষক, মাঠ, গবাদি পশু ও দেবী লক্ষ্মী - সবাই এক সূত্রে গাঁথা। ঝাড়খণ্ড থেকে শুরু করে সীমান্ত বাংলার আদিবাসী অঞ্চল - যেমন পুরুলিয়া, বাঁকুড়া, পশ্চিম মেদিনীপুর, ঝাড়গ্রাম - সব জায়গাতেই এই অনুষ্ঠান ঘরে ঘরে পালিত হয়।

লোকবিশ্বাস বলে, অতীতে এই অঞ্চলের মানুষ বনে-জঙ্গলে খাদ্য সংগ্রহ করেই বাঁচত। সময়ের সঙ্গে মানুষ কৃষিকর্ম ও গবাদি পশু পালনে অভ্যস্ত হয়। সেই জীবনযাত্রায় গরু-মহিষ হয়ে ওঠে পরিবারের সদস্যের মতো। তাই, বছরের এক দিন তাদের প্রতি কৃতজ্ঞতা প্রকাশের উৎসবে মেতে ওঠে লোকসমাজ - এই উৎসবই বাঁদনা পরব


উৎসবের কালক্রম ও ঐতিহ্য

কার্তিক মাসের অমাবস্যা তিথি থেকে বাঁদনা উৎসব শুরু হয়, আর তা গড়িয়ে চলে পৌষ সংক্রান্তি পর্যন্ত। এই তিথিকে গো-বন্দনার পবিত্র দিন বলা হয়। কৃষকের ঘরে নতুন শস্য জমে ওঠার সময়, তাই আনন্দও থাকে দ্বিগুণ। গরু-মহিষদের বিশেষভাবে স্নান করানো হয়, সাজানো হয় রঙিন মালা, আলতা, হালুদ ও ফুলের সাজে। কেউ কেউ তাদের গায়ে অল্প তেল মেখে পরিচ্ছন্ন করে দেয়, মাথায় রঙিন কাপড় বেঁধে উৎসবমুখর করে তোলে।

এই দিন প্রতিটি গ্রাম যেন এক মেলা। হাঁটতে গেলে দেখা যায়—গরুর গলায় ঘণ্টা ঝুলছে, দেহে আলপনা আঁকা, আর পাশে বাজছে ঢোল, কানসা, মহুরি। গরুদের নাচাতে নাচাতে তরুণেরা ঢাকের তালে তালে আকাশ মাতিয়ে তোলে।

অনেক স্থানে গরু ও মহিষের মিলন বা শুভ পরিণয়ের প্রতীকী অনুষ্ঠানও হয়—এ যেন প্রকৃতি, প্রাণ ও মানুষের চিরন্তন বন্ধনের উদযাপন।

জঙ্গলমহলের আদিবাসী সমাজের হৃদয়ে বাঁদনা

এই উৎসব শুধু কৃষিজীবী সমাজেই সীমাবদ্ধ নয়; মাহাত, ভূমিজ, সাঁওতাল ও কুড়মি সম্প্রদায়—সবার কাছে বাঁদনা এক প্রাণের পরব। তাই একে অনেকেই আদিবাসী সমাজের জাতীয় উৎসব বলেও অভিহিত করেন।

গ্রামবাংলার মানুষ এই দিনে মনে করে—শস্য, সন্তান ও শান্তি বজায় রাখার আশীর্বাদ আসে গো-মাতার আশীর্বাদ থেকেই। এই বিশ্বাসই প্রজন্মের পর প্রজন্ম ধরে বাঁদনাকে তাদের জীবনের অংশ করে তুলেছে।

উৎসবের পাঁচটি পর্যায়

বাঁদনা পরবকে ঘিরে জঙ্গলমহলে পাঁচটি বিশেষ ধাপ বা আচার পালিত হয়। প্রতিটি ধাপের আলাদা তাৎপর্য রয়েছে।

  1. কাঁচি দুয়ারি – বাঁদনা উৎসবের সূচনা পর্ব। ঘরদোর পরিষ্কার করা হয়, গবাদি পশুদের খোঁয়াড় গোছানো হয়, আর নতুন খড়, ধান ও তুলো দিয়ে গরুকে সাজানো হয়।

  2. গঠপূজা – এদিন কৃষক দেবী লক্ষ্মীর আরাধনা করেন। বিশ্বাস, শস্য দেবীর আশীর্বাদেই গরু-মহিষ সুখে থাকে ও ফসল ভালো হয়।

  3. জাগরণ বা গরইয়া – গ্রামের যুবক-যুবতীরা রাতে জেগে গান গায়, ঢোল বাজায়, নাচে। এটি উৎসবের প্রাণকেন্দ্র, যেখানে লোকসংগীত ও গ্রামীণ নাচ মিশে যায়।

  4. গরুখুঁটা – সবচেয়ে প্রাণবন্ত ও রঙিন পর্ব। গরু-মহিষদের খুঁটিতে বেঁধে নাচানো হয়, ডোল-ঢাকের তালে তারা লাফায়, ছুটে যায়। এই দৃশ্য দেখে ছোট-বড় সবাই মেতে ওঠে আনন্দে।

  5. বুড়ি বাঁদনা – সমাপ্তি অনুষ্ঠান। গ্রামের প্রবীণ নারী-পুরুষ গরুদের আশীর্বাদ করে, ধূপ আর প্রদীপ জ্বালানো হয়। সবাই মিলে খাওয়াদাওয়া, গানবাজনা আর মিলনমেলা।

মাটির টান আর কৃষকের হৃদয়

দক্ষিণ বাঁকুড়ার পাথুরে জমিতে চাষ করা সহজ নয়। সেই কঠিন মাটিকে চাষযোগ্য করে তোলে লাঙলের ফলায় ঘাম ঝরানো কৃষক আর তার গবাদি সঙ্গী। তাই কৃষক মনে করেন, গরু-মহিষ ছাড়া কৃষিকাজ অসম্পূর্ণ। এরা কেবল শ্রমের সঙ্গী নয়—তাদের সঙ্গে রয়েছে এক আত্মিক বন্ধন।

বাঁদনা সেই বন্ধন উদযাপন করে। এই উৎসব শেখায়, প্রকৃতিকে ভালোবাসলে, প্রাণীদের সহমর্মিতা দিলে, জীবনও পূর্ণ হয় কৃতজ্ঞতায়।

সংগীত, নৃত্য এবং লোকজ রঙ

বাঁদনা পরবের আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ দিক হলো লোকসংগীত ও নৃত্য। ঢাক, কাঁসা, তাসা, বংশী, করতাল - সব মিলিয়ে এক সুরের জগৎ তৈরি হয়। মহিলারা সাদা-লাল পাড়ের শাড়ি পরেন, পুরুষেরা ধুতি-পাঞ্জাবি, গায়ে পাগড়ি বা গামছা বেঁধে উৎসবে যোগ দেন।

গাওয়া হয় বাঁদনা গীত—যেখানে কৃষিজীবী মানুষের কষ্ট, আনন্দ ও আশা মিশে থাকে। গানের কথাগুলোতে থাকে গরুর প্রশংসা, দেবীর বন্দনা ও নতুন ফসলের আশীর্বাদ কামনা।

আধুনিক প্রেক্ষাপটে বাঁদনা

আজকের সময়ে শহুরে আলোর নিচেও বাঁদনার টান ম্লান হয়নি। অনেক শহরের আদিবাসী সংগঠন বা সাংস্কৃতিক দল এখন এই উৎসবকে প্রদর্শনী ও লোকসংস্কৃতি দিবস হিসেবে পালন করে। তারা চায় আগামি প্রজন্ম জানুক—বাঁদনা কোনো কুসংস্কার নয়, এটি মানুষ ও প্রাণীর সহাবস্থানের প্রতীক।

সামাজিক মাধ্যমেও এখন অনেক তরুণ বাঁদনা পরবের ভিডিও, গান ও নৃত্য রেকর্ড করে ছড়িয়ে দিচ্ছেন, যাতে এই ঐতিহ্য হারিয়ে না যায়।

আমার দেখা বাঁদনার আনন্দ

জঙ্গলমহলের এক গ্রামে দাঁড়িয়ে আমি নিজ চোখে দেখেছিলাম, কাঁড়া মাদী মহিষের গায়ে আলপনার রেখা, ষাঁড়ের গলায় রঙিন ফুলের মালা, আর পাশে ছোট্ট বাচ্চারা হাততালি দিয়ে নাচছে। বাতাসে ধান, গরুর ঘর্মগন্ধ, আলার তেলে ঝলমল আলো - সব মিলিয়ে এক মোহময় পরিবেশ। তখন মনে হয়েছিল, ধর্ম-বর্ণের গণ্ডি পেরিয়ে মানুষ এক হয়ে গেছে উৎসবে, যেমন মাটি আর ফসল একে অপরের পরিপূরক।

বাঁদনা শুধু একটি উৎসব নয়, এটি মানুষ ও জীবনের কবিতা - যা বলে, প্রকৃতিকে ভালোবাসাই মানবতার আসল অর্থ।

উপসংহার:বাঁদনা পরবের উৎসব জঙ্গলমহলের প্রাণের উৎসব। এটি আমাদের স্মরণ করিয়ে দেয়—প্রকৃতি, পশুপাখি, মাটি ও মানুষ পরস্পর জড়িয়ে আছে এক অবিচ্ছেদ্য বন্ধনে। এই উৎসব সেই বন্ধনের আনন্দময় প্রকাশ, যেখানে গরুর চোখে যেমন ভালোবাসা, তেমনি মানুষের মনে কৃতজ্ঞতা।

ভ্রাতৃদ্বিতীয়ার রঙে যখন আলো জ্বলে ঘরে ঘরে, তখন জঙ্গলমহলের এই বাঁদনা পরব মনে করিয়ে দেয় - ভাইবোনের মতোই মানুষ আর প্রাণীও একে অপরের আত্মীয়।








 

 

 

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

0মন্তব্যসমূহ

We welcome thoughtful discussions. Comments are moderated for quality

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন (0)

#buttons=(Ok, Go it!) #days=(20)

Our website uses cookies to enhance your experience. Check Now
Ok, Go it!