আড়ংঘাটার যুগলকিশোর মন্দির: চূর্ণী নদী তীরের ঐতিহাসিক জামাইমেলা ও কিংবদন্তি
বর্ধমানের রাজগঞ্জের মোহন্ত, স্বর্গীয় স্বামী শুকদেব দাসের শিষ্য গঙ্গারাম দাস। কিশোর বয়সে 'নিম্বার্ক সম্প্রদায় অনুযায়ী' সন্ন্যাস ধর্ম গ্রহণ করে, তীর্থভ্রমণে বৃন্দাবন গমন করে। পরবর্তীতে তিনি আড়ংঘাটায় কিশোর গোপীনাথ বিগ্রহ প্রতিষ্ঠা করেন। চলুন আপনি ও আমি, একবার ঘুরে আসি আড়ংঘাটার যুগলকিশোর মন্দির ও ঐতিহ্যবাহী জামাইমেলা থেকে।
চূর্ণী নদী ও যুগলকিশোর মন্দিরের ঠিকানা :
যুগলকিশোর মন্দির এই বঙ্গপ্রদেশের নদিয়া জেলার একটি প্রাচীন ধর্মীয় স্থাপনা, যা আড়ংঘাটা গ্রামে অবস্থিত। গ্রামটি ধানতলা থানার অন্তর্গত।
আড়ংঘাটা গ্রাম, রাজধানী কলকাতা থেকে প্রায় ৫৬ মাইল বা প্রায় ৯০ কিলোমিটার দূরে অবস্থিত। এই মন্দিরের পাশ দিয়ে শান্তস্বভাবা চূর্ণী নদী বয়ে চলেছে, যা যুগলকিশোর মন্দিরের পরিবেশকে করে তুলেছে আরও বৈষ্ণবীয়, স্নিগ্ধ ও আধ্যাত্মিক।
“অশ্রুচোখে হেমন্তের প্রভাত-শিশিরে,
ছলছল করে গ্রাম চূর্ণী নদীতীরে।”
এই কয়েকটি পঙ্ক্তির মধ্য দিয়েই কবি যেন চূর্ণী নদীর শান্ত, আবেগঘন সৌন্দর্য এবং বাংলার গ্রামীণ জীবনের অন্তর্লীন স্নিগ্ধতা তুলে ধরেছেন।
এছাড়াও, আঞ্চলিক বহু বিখ্যাত ও অক্ষত কবির কলমে চূর্ণী নদী ও আড়ংঘাটার এই প্রাচীন মন্দিরের উল্লেখ পাওয়া যায়।
📅 দর্শন সময়: প্রতিদিন সকাল ৭টা থেকে দুপুর ১২টা, ও বিকাল ৪টা থেকে রাত ৮টা পর্যন্ত।
📜 ইতিহাসে তীর্থভূমি: আড়ংঘাটা যুগলকিশোর মন্দিরের প্রতিষ্ঠা
কিংবদন্তি অনুসারে, বর্ধমান জেলার রাজগঞ্জ অঞ্চলের তৎকালীন সেবাইত মোহন্ত স্বামী শুকদেব দাসের শিষ্য ছিলেন গঙ্গারাম দাস। কিশোর বয়সেই তিনি শুকদেব দাসের কাছ থেকে দীক্ষা গ্রহণ করেন এবং নিম্বার্ক সম্প্রদায় অনুসারে সন্ন্যাস গ্রহণ করেন। গঙ্গারাম দীর্ঘদিন গুরু আশ্রমে থেকে সেবা-পূজার রীতি ও নিয়মাবলি শিখে নেন।
এরপর তিনি তীর্থভ্রমণে বের হন—উত্তর-পূর্ব বঙ্গ থেকে পশ্চিম ভারতের বিভিন্ন তীর্থ পদব্রজে ঘুরে অবশেষে পৌঁছান শ্রীধাম বৃন্দাবনে।
বৃন্দাবনে থাকার সময় গঙ্গারাম দাস কিশোর গোপীনাথের সেবার জন্য ব্যাকুল হয়ে পড়েন। কোনো এক নিশুতি রাতে তিনি স্বপ্নে দেখেন—কিশোর গোপীনাথ নিজে তাঁকে বলছেন, ‘গঙ্গারাম, কাঁদিস না। আমি তোর জন্য যমুনার জলে অপেক্ষা করছি। আমাকে তুলে এনে সেবাপূজা কর, তোর মনোবাঞ্ছা পূর্ণ হবে।’ এই স্বপ্নাদেশ পাওয়ার পর, যমুনার জলে স্নানকালে তিনি এক অলৌকিক কিশোর গোপীনাথ মূর্তি পেলেন। যদিও মূর্তিটি কীভাবে পেলেন, সে বিষয়ে লিখিত কোনো প্রমাণ নেই, তবে মৌখিক জনশ্রুতি অনুযায়ী এই কাহিনি আজও প্রচলিত।
মূর্তি সহ গangarাম দাস পদব্রজে বাংলার দিকে রওনা দিলেন, এবং নবদ্বীপের কাছে সমুদ্রগড় অঞ্চলে পৌঁছে কিশোর গোপীনাথ বিগ্রহ স্থাপন করে।
সমুদ্রগড় অঞ্চলে অবস্থানকালে বর্গী হাঙ্গামার সময় গঙ্গারাম দাস কিশোর গোপীনাথ বিগ্রহ সঙ্গে নিয়ে রাজা কৃষ্ণচন্দ্রের রাজ্যে চলে আসেন।
লোককথা অনুযায়ী, রাজা কৃষ্ণচন্দ্রের কর্মচারী রামপ্রসাদ পাঁড়ের সহযোগিতায় গঙ্গারাম দাস আড়ংঘাটার চূর্ণী নদীর তীরে, পাঁড় পরিবারভুক্ত জমির সীমানায় কিশোর গোপীনাথের নিত্য সেবাপূজা শুরু করেন। বর্তমান যুগল মন্দিরের দক্ষিণে অবস্থিত পাঁড়ের বাড়ি বা ‘গোপীনাথ বাড়ি’।
এরপর শুরু হয় কিশোর গোপীনাথের সেবাপূজা। কিছুদিন পর গঙ্গারাম দাস আবার একটি স্বপ্ন দর্শন করেন—স্বপ্নে কিশোর গোপীনাথ তাঁকে দেখান যে, তাঁর রাধারানি রয়েছেন কৃষ্ণনগরের রাজপ্রাসাদে।
তবে সমস্যার বিষয় ছিল, কৃষ্ণচন্দ্র রাজা ছিলেন শক্ত মতে বিশ্বাসী—বৈষ্ণবদের থেকে বহু যোজন দূরে। এই স্বপ্ন-ঘটনার কথা জানিয়ে গঙ্গারাম দাস তাঁর অনুগত রামপ্রসাদ পাঁড়কে পাঠান রাজদরবারে। কিন্তু রাজা কৃষ্ণচন্দ্র সে কথা আমলেই নেননি—অর্থাৎ বিষয়টি খারিজ করে দেন।
এরপর শুরু হয় কিশোর গোপীনাথের নিত্য সেবাপূজা। কিছুদিন পর গঙ্গারাম দাস একটি স্বপ্ন দেখেন — স্বপ্নে কিশোর গোপীনাথ তাঁকে বলেন।- “আমার রাধারানি রয়েছেন কৃষ্ণনগরের রাজপ্রাসাদে।”
এই স্বপ্নাদেশের কথা গঙ্গারাম দাস তাঁর অনুগত ভক্ত রামপ্রসাদ পাঁড়কে জানালে, রামপ্রসাদ রাজদরবারে গিয়ে বিষয়টি মহারাজা কৃষ্ণচন্দ্রকে জানান। কিন্তু রাজা প্রথমে একক রাধার অস্তিত্ব মানতে অস্বীকার করেন এবং ঘটনাটি খারিজ করে দেন। কারণ, রাজা কৃষ্ণচন্দ্র ছিলেন মূলত শক্তমতে বিশ্বাসী এবং বৈষ্ণব ধারা থেকে অনেক দূরে। তাছাড়া, রাজ্ গৃহে যত কৃষ্ণ ছিল সবাই রাধাকৃষ্ণ যুগল রূপেই পুজোটা হতো।
তবে বিস্ময়করভাবে কিছুদিন পর রাজপ্রাসাদের সংস্কারকাজ চলাকালীন, ভূগর্ভ থেকে একটি অষ্টধাতুর একক রাধিকা মূর্তি উদ্ধার হয়। এরপর রাজা কৃষ্ণচন্দ্র বজরা নিয়ে নৌকাবিহারে এসে সেই রাধা কিশোরী মূর্তি গঙ্গারাম দাসের হাতে অর্পণ করেন। ও বকুল বৃক্ষতলে মহাসমারোহে কিশোর গোপীনাথের ও কিশোরী রাধা রানীর বিয়ে দেন। এবং তখন থেকেই রাধা কৃষ্ণের যুগল মূর্তিকে নাম রাখা হয় - "যুগলকিশোর"। রাজা কৃষ্ণচন্দ্র কিশোর গোপীনাথকে "জামাই" রূপে গ্রহণ করেন। পরের দিন পরদিন ১লা জ্যৈষ্ঠ থেকে একমাস কাল এই যুগল মিলনে আনন্দ উৎসব পালনের আয়োজন করিয়াছিলেন।
এখনো সেই রীতি মেনে জ্যৈষ্ঠ মাসজুড়ে মেলা চলে। স্থানীয়ভাবে এই মেলাটিকে 'জামাই মেলা' নামে ডাকেন।
রামপ্রসাদ পাঁড়ের অনুরোধে ও উৎসাহে মহারাজা কৃষ্ণচন্দ্র আড়ংঘাটার মন্দির নির্মাণ ও সেবার জন্য দুটি গুরুত্বপূর্ণ জমিদান করেন—
👉 দেবমন্দির নির্মাণের জন্য ১৬ বিঘা জমির দানপত্র।
👉 ফুলবাগান সজ্জার জন্য ৪ চারি বিঘা জমির দানপত্র।
এই দুটি দানপত্রই বাংলা সন ১১৫১ সালে (ইংরেজি ১৭৪৪ সাল নাগাদ) প্রদান করা হয়।এগুলো কোনও লোককথা বা অনুমান নয়—উক্ত দানপত্রদ্বয় আজও যুগলকিশোর মন্দিরে সযত্নে সংরক্ষিত রয়েছে।
এছাড়াও, যুগলকিশোর দেবের এই অলৌকিক মিলনের স্মৃতিস্বরূপ, মহারাজা কৃষ্ণচন্দ্র রায় বাহাদুর সেবাইত গঙ্গারাম দাসের নামে সুষ্ঠুভাবে যুগলকিশোরের সেবাপূজা পরিচালনার জন্য একশত (১০০) বিঘার একখণ্ড জমি দানপত্রমূল্যে অর্পণ করেন।এই জমিদানটি প্রদান করা হয় বাংলা সন ১১৫৪ সালে (প্রায় ১৭৪৭ খ্রিষ্টাব্দে)।অদ্যাবধি সেই প্রাচীন দানপত্রটি যুগলকিশোর মন্দিরে সযত্নে সংরক্ষিত রয়েছে।
🧘♂️ সেবাইত মোহন্তগণের ধারাবাহিকতা
আড়ংঘাটা যুগল মন্দিরের সেবাপূজা প্রথা চলে আসছে ধারাবাহিকভাবে মহন্ত বা সেবাইতদের মাধ্যমে। নিচে উল্লেখযোগ্য কিছু মহন্তের নাম, স্থিতিকাল ও তিরোভাবের তথ্য তুলে ধরা হলো:
মহন্তের নাম | স্থিতিকাল | তিরোভাব তিথি |
---|---|---|
গঙ্গারাম দাস | ৪০ বছর | আষাঢ়ী শুক্লা ত্রয়োদশী |
যশোদানন্দ দাস | ৩০ বছর | মাঘী শুক্লা সপ্তমী |
শ্রীচরণ দাস | ২৯ বছর | ভাদ্র কৃষ্ণা একাদশী |
হরিদাস দাস | ৩০ বছর | কার্তিকী অমাবস্যা |
শুকারাম দাস | ৩৬ বছর | চৈত্র শুক্লা চতুর্থী |
রঘুনাথ দাস | ৫ বছর | মাঘী কৃষ্ণা ত্রয়োদশী |
অনন্ত দাস | ৩২ বছর | চৈত্র কৃষ্ণা সপ্তমী |
রামদাস দাস | সাড়ে তিন মাস | শ্রাবণ কৃষ্ণা নবমী |
সনকাদিক দাস | ৪৭ বছর | বৈশাখী কৃষ্ণ একাদশী |
অনিরুদ্ধ দাস | ৪৪ বছর | মাঘী কৃষ্ণা একাদশী |
বর্তমান মোহন্ত শ্যামদাস | ২০১৪ সাল থেকে | নিয়মিত সেবা রত আছেন |
সেবাপূজার বিধি : শ্রীশ্রী যুগলকিশোর মন্দিরে
শ্রীশ্রী যুগলকিশোর মন্দিরে সেবাপূজার কিছু বিশেষ নিয়ম প্রচলিত। কোনো ভক্ত যদি এখানে সেবাপূজা করতে চান, তবে তাঁকে পূর্বাহ্নে মন্দিরের পূজারীর নিকট থেকে সেবার নির্দিষ্ট বিধান জেনে নিতে হয়।
- 🔸 এখানে কাটা ফল বা বাজারজাত মিষ্টান্ন ভোগে নিবেদনযোগ্য নয়।
- 🔸 চিনি বা বাতাসা—এই দুটি ছাড়া অন্য কোনো বাজারজাত অন্নজাত মিষ্টি দ্রব্য সেবায় গ্রহণ করা হয় না।
- 🔸 কোনো কোনো ভক্ত যখন অন্ন-ব্যঞ্জন বা ঘৃত-আটা ইত্যাদি দ্বারা ভোগ নিবেদন করতে চান, তখন পূজারী বা স্বয়ং মোহন্ত মহারাজের সঙ্গে পরামর্শ করে সে অনুযায়ী ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হয়।
মন্দিরে গৃহ ও বিগ্রহ পরিচিতি
মন্দিরে পাঁচটি দ্বার রয়েছে এবং প্রতিটি দ্বারেই পৃথক পৃথক বিগ্রহ মূর্তি স্থাপিত, মধ্যদ্বার: এখানেই প্রধান সিংহাসনে বিরাজমান শ্রীশ্রী যুগলকিশোর দেবের যুগল মূর্তি।
![]() |
গোপীনাথজিউ |
💢 দক্ষিণের প্রথম দ্বার: এখানে বিরাজমান আছেন রাধাগোবিন্দের যুগল মূর্তি, যাঁকে একসময় রামপ্রসাদ পাঁড় নিজ বাড়িতে পূজা করতেন। এই বিগ্রহই শ্রীশ্রী গোপীনাথজিউ।
![]() |
রাধাবল্লভজিউ |
💢 দ্বিতীয় দ্বারে : শ্রীশ্রী রাধাবল্লভ বিগ্রহ মূর্তি সিংহাসনে অবস্থিত আছেন।
💢 তৃতীয় দ্বারে বা মধ্যদ্বারে স্বয়ং শ্রীশ্রী যুগলকিশোর বিগ্রহ অবস্থিত। এবং এই সিংহাসনে অধিষ্ঠিত আছেন শ্রীশ্রী বলরাম ও রেবতী দেবী। এ বিগ্রহ ছাড়াও বহু শালগ্রাম শিলা যুগল মন্দিরে রক্ষিত রয়েছে, যা সকল দর্শনার্থীর জন্য বিশেষভাবে দর্শনীয় ও পূজনীয়।
💢 চতুর্থ দ্বারে শ্রীশ্রী কালাচাঁদ বিগ্রহ মূর্তি সিংহাসনে এককভাবে অধিষ্ঠিত। তাঁর পার্শ্বে কোনো রাধিকা মূর্তি নেই। ইনি চিরকালই একক বিগ্রহ রূপে সেবা পূজা গ্রহণ করে আসছেন।
💢 পঞ্চম দ্বারে শ্যামচাঁদ বিগ্রহ সিংহাসনে শ্রীমতী সহ সেবাপূজা পাইয়া থাকেন।
মন্দিরের উত্তর-পূর্ব কোণে অবস্থিত ‘চরণ পাদুকা ঘরে’ আদিকাল থেকে যেসব সেবাইত মোহন্তগণ শ্রীশ্রী যুগলকিশোর দেবের সেবা-পূজা করে পরমধাম লাভ করেছেন, তাঁদের সকলের কাঠের পাদুকা আজও সযত্নে রক্ষিত ও পূজিত হয়ে থাকে।
তাছাড়া, মন্দির প্রাঙ্গণের সেই প্রাচীন বকুল গাছের তলে শিলারূপে প্রতিষ্ঠিত আছেন যষ্ঠী দেবী।
দোতলায় অবস্থিত সাবিত্রী যাত্রা মূর্তিতেও প্রতিদিন শত সহস্র ভক্ত নারী স্বহস্তে সিঁদুর ও লৌহ দান করেন।
এছাড়া আরও বহু বিগ্রহ মূর্তি জ্যৈষ্ঠ মাসে বিশেষভাবে মন্দিরের বাইরে প্রদর্শিত হয়, যেগুলিকে সাধু-সন্ন্যাসীরা সেবায় নিয়ে থাকেন। দোতলার আরেকটি বিশেষ দর্শনীয় বিগ্রহ হলো গোপাল মূর্তি, যাঁকে কেবলমাত্র জ্যৈষ্ঠ মাসেই দর্শন করা যায়। লোককথা অনুযায়ী, স্বর্গীয় মোহন্ত শ্রীস্বামী অনন্ত দাসজি মহারাজ একদিন ব্রাহ্মমুহূর্তে চূর্ণী নদীতে স্নান করতে গেলে, সেই অলৌকিক গোপাল ঠাকুর তাঁর কোলে উঠে আসেন। এই ঘটনাটি বাংলা সন ১৩০০-এর কিছু পরবর্তী সময়, আনুমানিক ২/১ বছরের মধ্যেই ঘটে।
![]() |
যুগলেশ্বর মহাদেবের মন্দির |
যুগল মন্দিরের পশ্চিমদিকে, চূর্ণী নদীর বাঁধানো ঘাটের উপর অবস্থিত যুগলেশ্বর মহাদেবের মন্দির। শিবচতুর্দশী, চৈত্রসংক্রান্তি প্রভৃতি তিথিতে এখানে ভক্তদের বিপুল সমাগম ঘটে এবং মহাদেবের সেবাপূজা এক মহোৎসবের রূপ নেয়।
এখানে আরও একটি লোককাহিনির প্রচলন রয়েছে—যুগল মন্দিরের সম্মুখে অবস্থিত প্রাচীন বকুল গাছটিকে কেন্দ্র করে এক বিশেষ লোকাচার গড়ে উঠেছে। ভক্তরা নিজেদের কামনা-বাসনা জানিয়ে এই বকুল গাছে ছোট ছোট ইটখণ্ড বা ঢেলা বাঁধেন। বিশেষ করে যুবতী বিবাহযোগ্য কন্যারা, মনের মতো জীবনসঙ্গী লাভের আশায়, যুগলকিশোরের চরণে প্রার্থনা করে এই গাছে ঢেলা বাঁধেন।
এই রীতির সূচনা ঠিক কবে থেকে, তার লিখিত প্রমাণ না থাকলেও, লোকমুখে প্রচলিত আছে যে যুগ-যুগান্তর ধরে এই ঐতিহ্য চলে আসছে। কেউ কেউ আশাপূরণের জন্য ঢেলা বেঁধে যান, আবার কেউ আশাপূর্তি হলে সেই ঢেলা খুলে দিয়ে কৃতজ্ঞ চিত্তে বাড়ি ফিরে আসেন।
এই গভীর ভক্তি, বিশ্বাস এবং লোকসংস্কৃতির ধারাই যুগল মন্দিরকে একটি অনন্য তীর্থক্ষেত্র ও মানবিক অনুভূতির কেন্দ্র হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করেছে।
আড়ংঘাটার নামকরণ
"আড়ংঘাটা" নামটি কখন এবং কীভাবে প্রচলিত হলো, তা সঠিকভাবে জানা যায় না। তবে লোককথা অনুযায়ী, প্রাচীনকালে এখানে অরণ্য এবং নদী ছিল, তেমন কোন বসতি ছিল না। নদীর ঘাট এবং অরণ্যের কারণে হয়তো এই স্থানের নাম অরণ্যঘাটা থেকে আস্তে আস্তে "আড়ংঘাটা" হয়ে উঠেছে।
আবার কিছু লোকের মতে, কিশোর গিপিনাথ ও কিশোরীর মিলনকালে এখানে নদীর ঘাটের ওপর আড়ৎ বসানো হতো, তাই এই স্থানের নাম "আড়ংঘাটা" বা "আড়ংঘাট" রূপে পরিচিত।
যাই হোক, এসব কেবল জনশ্রুতি মাত্র, আর এর প্রকৃত ইতিহাস কোনো লেখ্যদস্তাবেজে পাওয়া যায় না।
🧭 কিভাবে যাবেন যুগল মন্দিরে?
📍 অবস্থান: আড়ংঘাটা, নদীয়া জেলা, পশ্চিমবঙ্গ। 🚉 নিকটতম রেলস্টেশন: আড়ংঘাটা।
১ নম্বর প্ল্যাটফর্ম থেকে নামলে বা স্টেশন থেকে পশ্চিম দিকে ৫ থেকে ৭ মিনিট হাঁটলে একই রাস্তার উপর ‘যুগলকিশোর মন্দির’ রয়েছে।
🚉 ট্রেন ছাড়াও বিকল্প হিসেবে রানাঘাট স্টেশন থেকে আড়ংঘাটা পর্যন্ত অটো-রিকশার পরিষেবা পাওয়া যায়। বর্তমানে অটোর ভাড়া প্রায় ২৫ টাকা।
সেবায়েত ৫৩ বছর ধরে নিষ্ঠার সঙ্গে এই মন্দিরের সেবায় নিয়োজিত। তিনি আরও জানান, রাজপরিবারের কেউই এখন আর এই মন্দিরের খোঁজখবর রাখেন না। তিনি কখনও তাদের দেখা পাননি বা চিনেন না।
তবে তিনি বলেন, তাঁদের পূর্বপুরুষ কিশোর গোপীনাথকে রাজপরিবারের "জামাই" বলে সম্বোধন করতেন। তাই যদি কখনও রাজপরিবারের কেউ মন্দির প্রাঙ্গণে আসেন, তবে তিনি আন্তরিকভাবে খুশি হবেন।
We welcome thoughtful discussions. Comments are moderated for quality