![]() |
ঐতিহ্যে ছৌ নৃত্য |


বিশ্বামিত্র সিং সর্দার
পুরুলিয়া থেকে তথ্যদাতা
📍 ভারত (India)
Orange guest Tick Approval
চড়িদা, পুরুলিয়া:ভারতের সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যে ছৌ নৃত্যের এক বিশেষ স্থান রয়েছে। আর এই ঐতিহ্যকে আন্তর্জাতিক পর্যায়ে তুলে ধরেছেন যিনি, তিনি হলেন — পদ্মশ্রী গম্ভীর সিং মুড়া, যাঁকে আজ আমরা শ্রদ্ধাভরে স্মরণ করি "ছৌ সম্রাট" নামে। ভারতের পশ্চিমবঙ্গ রাজ্যের পুরুলিয়া জেলার বাঘমুন্ডী ব্লকের ছোট্ট গ্রাম চড়িদা, ছৌ-নৃত্যের একটি বিশিষ্ট কেন্দ্র হিসেবে পরিচিত। গম্ভীর সিং মুড়ার অসাধারণ জীবন সংগ্রাম এবং নৃত্য প্রতিভা ছৌ-নৃত্যকে ভারতের গণ্ডি ছাড়িয়ে আন্তর্জাতিক মঞ্চে পৌঁছে দিয়েছে। ছৌ-নৃত্যের প্রতি তাঁর অবদান এতটাই গভীর, যে তিনি আজও বাংলার সংস্কৃতির অমূল্য রত্ন হিসেবে বিবেচিত।
জন্ম ও শৈশব
গম্ভীর সিং মুড়ার জন্ম ১৯৩০ সালের ২রা মার্চ, ব্রিটিশ শাসিত অবিভক্ত মানভূম জেলার (বর্তমান পুরুলিয়া জেলা) পিটিদিরি গ্রামে, তাঁর মামার বাড়িতে। তিনি ছৌ নৃত্যশিল্পী জিপা সিং মুড়ার কনিষ্ঠ পুত্র হিসেবে জন্মগ্রহণ করেন। শৈশবে গম্ভীর সিং-এর ডাকনাম ছিল ‘বাবু’। গম্ভীর সিং মুড়ার জন্ম হয়েছিল এক দরিদ্র আদিবাসী পরিবারে। তাঁর পিতা জিপা সিং মুড়া ছিলেন একজন ভূমিহীন কৃষি শ্রমিক, যিনি ছৌ-নৃত্যে পারদর্শী ছিলেন এবং নিজে একটি দল পরিচালনা করতেন। তাঁর মা ফুলমণি সিং মুড়া ছিলেন এক সাধারণ গৃহবধূ।
![]() |
পদ্মশ্রী গম্ভীর সিং মুড়া |
খুব অল্প বয়সে পিতৃহীন গম্ভীর সিং মুড়া তাঁর মাতুলালয়ে পিটিদিরি গ্রামে চৌদ্দ বছর বয়স পর্যন্ত বাস করেন। ১৯৪৩ সালে তিনি তাঁর পৈতৃক ভিটে চড়িদা গ্রামে চলে যান। তাঁর পরিবারে ছিলেন দুই দাদা এবং এক বোন।
চরম দারিদ্র্য ও সংগ্রামী শৈশব
শৈশবে তাঁকে নানান কষ্ট সহ্য করতে হয়েছে। অর্ধাহারে-অনাহারে দিন কাটতো, গরু চরানো, তীর ধনুক নিয়ে শিকার, এবং ছোট ছোট কাজ করে পরিবারের পাশে দাঁড়াতে হতো। মাত্র ১৩ বছর বয়সে তাঁর বাবার রহস্যজনক মৃত্যু ঘটে, যার ফলে তাঁদের পরিবার একেবারে ভেঙে পড়ে এবং বাধ্য হয়ে পিতৃভূমি চড়িদা গ্রামে ফিরে আসে। এখানেই শুরু হয় গম্ভীর সিং মুড়ার নতুন সংগ্রাম ও নৃত্যযাত্রার অধ্যায়।
![]() |
মহান শিল্পী গম্ভীর সিং খাপরা চালায় বাঁদিকের ঘরটিতে বসবাস করতেন। ডানদিকের ঘরটি গোয়াল। |
নৃত্যজীবনের শুরু
গরু চরাতে গিয়ে জঙ্গলের পশু-পাখির অঙ্গভঙ্গি অনুকরণ করতেন, তাদের হাঁটা, দৌড়, লাফালাফি তাঁকে নৃত্য শেখাত। তাঁর ভাষায়, তাঁর প্রথম গুরু ছিলেন অযোধ্যা পাহাড়ের জঙ্গল। বাবা থেকেই ছৌ-নৃত্যের প্রাথমিক শিক্ষা পেয়েছিলেন, আর নিজে নিজেই তা অনুশীলনের মাধ্যমে আরও দক্ষ করে তোলেন। প্রতিদিন তিনি নাচের ভঙ্গিমা নিয়ে গরু চরাতে যেতেন এবং ধীরে ধীরে নিজেই নিজেকে তৈরি করতেন একজন দক্ষ ছৌ-শিল্পী হিসেবে।
![]() |
গম্ভীর সিং মুড়ার |
🎭 ছৌ-নৃত্যের প্রতি তাঁর অঙ্গীকার
১৯৫৬ সালে এক মারাত্মক রোগে আক্রান্ত হয়ে গম্ভীর সিং মুড়া লহরিয়া শিবমন্দিরে তিন মাস ধরে উপবাস ও প্রার্থনা করেন। রোগমুক্তির পর তিনি প্রতিজ্ঞা করেন, প্রতি বছর চৈত্র মাসে চড়ক উৎসবে লহরিয়ার শিবমন্দির প্রাঙ্গণে ছৌ-নৃত্য পরিবেশন করবেন। এই প্রতিজ্ঞা তিনি মৃত্যুর আগ পর্যন্ত অটলভাবে পালন করেন। তাঁর মৃত্যুর পর তাঁর পুত্ররাও এই ঐতিহ্য নিষ্ঠার সঙ্গে বজায় রেখে চলেছেন।
ছৌ-নৃত্যের প্রসারে তাঁর অবদান
ছৌ নৃত্য (বা ছো নাচ) হল এক ধরনের ভারতীয় আদিবাসী যুদ্ধনৃত্য, যা পশ্চিমবঙ্গ, ঝাড়খণ্ড ও ওড়িশা রাজ্যে বিশেষভাবে জনপ্রিয়। এই নৃত্যকলার উৎপত্তিস্থল পশ্চিমবঙ্গের পুরুলিয়া জেলা বলে মনে করা হয়। ছৌ নৃত্যের আদি উৎস ও বিকাশের ভিত্তিতে একে তিনটি প্রধান উপবর্গে ভাগ করা হয়—
১. পুরুলিয়া ছৌ (পশ্চিমবঙ্গ)
২. সরাইকেলা ছৌ (ঝাড়খণ্ড)
৩. ময়ূরভঞ্জ ছৌ (ওড়িশা)
এই তিনটি উপবর্গের মধ্যে মূল পার্থক্য দেখা যায় মুখোশ ব্যবহারের দিক থেকে। পুরুলিয়া ও সরাইকেলা ছৌ-তে মুখোশ ব্যবহৃত হয়, কিন্তু ময়ূরভঞ্জ ছৌ-তে মুখোশ ব্যবহৃত হয় না। এছাড়াও নৃত্যের ভঙ্গিমা, সঙ্গীতের ধরন এবং পোশাকেও কিছু পার্থক্য দেখা যায়।
ছৌ নৃত্যের নাম নিয়ে নানা বিতর্ক থাকলেও, কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের রবীন্দ্র অধ্যাপক ড. আশুতোষ ভট্টাচার্য সর্বপ্রথম "ছৌ" নামটি প্রাতিষ্ঠানিকভাবে পরিচিত করে তোলেন। তাঁর গবেষণা ও বিদেশে এই নৃত্যরূপের প্রদর্শনের মাধ্যমে "ছৌ" নামটি আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি লাভ করে।
🌍 ছৌ-নৃত্যের আন্তর্জাতিক যাত্রা
অধ্যাপক ড. আশুতোষ ভট্টাচার্যের অগ্রণী উদ্যোগে ছৌ-নৃত্য প্রথমবারের মতো আন্তর্জাতিক মঞ্চে পৌঁছে। ১৯৭২ সালে তাঁর নেতৃত্বে গম্ভীর সিং মুড়ার অধীনে ১১ জন শিল্পী নিয়ে একটি দল ইউরোপের লন্ডন, প্যারিস, হল্যান্ড ও স্পেনের বিভিন্ন শহরে ছৌ-নৃত্য পরিবেশন করে। এই নৃত্যশৈলী ইউরোপীয় দর্শকদের অভিভূত করে এবং ভারতীয় লোকসংস্কৃতির অনন্য পরিচয় তুলে ধরে।
এরপর, ১৯৭৫ সালে তাঁরা উত্তর আমেরিকায় নিউ ইয়র্ক, বোস্টন, লস অ্যাঞ্জেলেস, সান ফ্রান্সিসকো, হাওয়াই, হনোলুলু এবং কানাডার সেন্ট ক্যাথারিন্স ও ওয়াটারলুর মতো শহরগুলোতে ছৌ-নৃত্য প্রদর্শন করেন। এসব পরিবেশনা ভারতের সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যকে আন্তর্জাতিক মহলে মর্যাদার আসনে প্রতিষ্ঠিত করে।
🏆 গম্ভীর সিং মুড়ার সম্মান ও অবদান
ছৌ-নৃত্যে অসামান্য অবদানের জন্য গম্ভীর সিং মুড়াকে ১৯৮১ সালে ভারতের রাষ্ট্রপতি নীলম সঞ্জীব রেড্ডি ‘পদ্মশ্রী’ পুরস্কারে সম্মানিত করেন। এর পরের বছর, ১৯৮২ সালে রাষ্ট্রপতি জ্ঞানী জেল সিং তাঁকে ‘সঙ্গীত নাটক আকাদেমি’ পুরস্কারে ভূষিত করেন। শুধু তাই নয়, তিনি ব্লক, জেলা ও রাজ্য স্তরে অসংখ্য সাংস্কৃতিক সম্মাননা অর্জন করেন।
১৯৮৬ সালে তিনি দ্বিতীয়বারের মতো প্যারিসের মঞ্চে এবং ১৯৯১ সালে টোকিওর একটি খ্যাতনামা মঞ্চে ছৌ-নৃত্য পরিবেশন করেন। ১৯৪৬ থেকে ১৯৯১ সাল পর্যন্ত দীর্ঘ সময় ধরে ছৌ-নৃত্যে তাঁর কোনও সমকক্ষ শিল্পী দেখা যায়নি। তাঁর অসাধারণ নৃত্যগুণ ও সৃজনশীলতার স্বীকৃতিস্বরূপ তিনি বহু পুরস্কার ও সম্মানে ভূষিত হন। সর্বোচ্চ নাগরিক সম্মান ‘পদ্মশ্রী’-র পাশাপাশি তিনি রাজ্য ও কেন্দ্রীয় সরকারের নানা সাংস্কৃতিক পুরস্কার লাভ করেন, যা তাঁর শিল্পীজীবনের এক অনন্য স্বীকৃতি।
![]() |
গম্ভীর সিং মুড়ার স্মরণে ভারতীয় ডাক বিভাগ (India Post) একটি স্মারক ডাকটিকিট প্রকাশ করে। |
📮 স্মারক ডাকটিকিট:২০২৩ সালে ভারতীয় ডাক বিভাগ (India Post) গম্ভীর সিং মুড়ার স্মরণে একটি স্মারক ডাকটিকিট প্রকাশ করে। এটি ছিল শুধু একজন নৃত্যশিল্পীর প্রতি শ্রদ্ধাঞ্জলি নয়, বরং ছৌ নৃত্যশিল্পের একটি জাতীয় স্বীকৃতি।
⚰️ গম্ভীর সিং মুড়ার মৃত্যু
দেশ-বিদেশে অসংখ্য সম্মান ও পুরস্কার অর্জন করলেও গম্ভীর সিং মুড়ার ব্যক্তিগত জীবন ছিল দারিদ্র্যক্লিষ্ট। শিল্পীর জীবনের শেষ পর্বে অর্থাভাবের মধ্যে দিন কাটাতে হয় তাঁকে। ২০০২ খ্রিষ্টাব্দের ১লা নভেম্বর কলকাতায় তাঁর চোখের অপারেশন হয়। অপারেশনের পর চিকিৎসকদের পরামর্শে তিনি বাড়ি ফেরার সিদ্ধান্ত নেন।
৯ই নভেম্বর, তিনি ৩১৫ আপ হাওড়া–চক্রধরপুর প্যাসেঞ্জার ট্রেনে হাওড়া থেকে পুরুলিয়ার উদ্দেশ্যে রওনা দেন। কিন্তু সেই যাত্রাপথেই ট্রেনের মধ্যেই হৃদরোগে আক্রান্ত হয়ে তাঁর মৃত্যু ঘটে। জীবনের শেষ মুহূর্ত পর্যন্ত তিনি নিজ জেলার মাটিতেই ফিরে যাওয়ার আকাঙ্ক্ষা পোষণ করেছিলেন। ছৌ-নৃত্যের এই কিংবদন্তি শিল্পীর প্রয়াণে ভারতের লোকসংস্কৃতি হারায় এক অমূল্য রত্ন।
🔶 গম্ভীর সিং মুড়ার সাংস্কৃতিক উত্তরাধিকার
তিনি বহু ছৌ শিল্পীকে প্রশিক্ষণ দিয়েছেন। তাঁর সন্তান সুকুমার মুড়া সহ পরিবারের অন্য সদস্যরাও ছৌ নৃত্যের ধারাকে সমৃদ্ধ করে চলেছেন। পুরুলিয়ার চড়িদা গ্রাম, যা আজ ‘মুখোশগ্রাম’ নামে খ্যাত, সেই গ্রামের নাম উজ্জ্বল করেছেন গম্ভীর সিং মুড়া।
উপসংহার
পদ্মশ্রী গম্ভীর সিং মুড়ার জীবনযাত্রা প্রমাণ করে—চরম দারিদ্র্য, শারীরিক কষ্ট ও সামাজিক প্রতিকূলতা সত্ত্বেও অদম্য ইচ্ছাশক্তি আর পরিশ্রম মানুষকে কোথায় নিয়ে যেতে পারে। তাঁর জীবনের গল্প শুধুই এক ছৌ-নৃত্য শিল্পীর কাহিনি নয়, বরং তা বাংলার সাংস্কৃতিক ইতিহাসের এক গৌরবময় অধ্যায়। আজও তাঁর নৃত্যধারা চড়িদা ও আশেপাশের গ্রামে বেঁচে আছে, তরুণ প্রজন্ম তাঁর দেখানো পথে হাঁটছে।
এই কিংবদন্তির প্রতি আমাদের বিনম্র শ্রদ্ধা ও প্রণাম। তাঁর জীবনচর্চা এবং শিল্পনৈপুণ্য আগামী প্রজন্মের জন্য এক অমূল্য শিক্ষা হয়ে থাকবে।
We welcome thoughtful discussions. Comments are moderated for quality