ধন্বন্তরী কালীবাড়ি, জয়নগর-মজিলপুর: চার শতাব্দীর জাগ্রত তান্ত্রিক শক্তিপীঠ

ধন্বন্তরী কালীবাড়ি, জয়নগর-মজিলপুর: চার শতাব্দীর জাগ্রত তান্ত্রিক শক্তিপীঠ

লালপেঁচা.in – বাংলার না-বলা কথা
0

ধন্বন্তরী কালীমন্দির, জয়নগর-মজিলপুর দক্ষিণ ২৪ পরগনা

 

Author
Raju Biswas
Published on: May 13, 2025
🔰 জয়নগর-মজিলপুর, দক্ষিণ ২৪ পরগনা, ৯ মে: জয়নগর-মজিলপুর রেলস্টেশনের ঠিক পাশেই, জয়নগর মজিলপুর পৌরসভার ৫ নম্বর ওয়ার্ডে অবস্থিত ধন্বন্তরী কালীবাড়ি—যার ইতিহাস প্রায় ৪০০ বছরের পুরোনো। ন্যাতড়া অঞ্চলের বিখ্যাত তান্ত্রিক সাধক ভৈরবানন্দ গোস্বামী তন্ত্রসাধনায় সিদ্ধ হয়ে বর্তমান মন্দির-সংলগ্ন পুকুর থেকে দেবী কালীর যন্ত্রমূর্তি উদ্ধার করেন।

ধন্বন্তরী কালীমন্দির, জয়নগর-মজিলপুর দক্ষিণ ২৪ পরগনা
জয়নগর-মজিলপুর রেলস্টেশন
 একবার গঙ্গার তীরে ধ্যান করার সময় তিনি একটি শিলার আংশিক বিগ্রহ আবিষ্কার করেন। যদিও এটি পূর্ণাঙ্গ মূর্তি ছিল না, তবুও তার মাধ্যমেই শুরু হয় মা ধন্বন্তরী কালীর তান্ত্রিক আরাধনা।

ভৈরবানন্দ গোস্বামীর শিষ্য রাজেন্দ্রনাথ চক্রবর্তী হন এই শক্তিপীঠের প্রথম সেবায়েত। সেই ঐতিহ্য আজও চক্রবর্তী পরিবারে উত্তরাধিকার সূত্রে অটুটভাবে বহাল রয়েছে—প্রজন্মের পর প্রজন্ম ধরে তাঁরা এই পূজার সেবা ও দায়িত্ব পালন করে আসছেন।

ধন্বন্তরী কালীমন্দির, জয়নগর-মজিলপুর দক্ষিণ ২৪ পরগনা
মা ধন্বন্তরী কালী

 📜 ইতিহাসের পাতায় ধন্বন্তরী কালী : ১৮শ শতকে ন্যাতড়া থেকে আগত সাধক ভৈরবানন্দ গোস্বামী তন্ত্রসাধনার মাধ্যমে এখানে দেবী কালীকে প্রতিষ্ঠা করেন। গঙ্গার ধারে খনন করে পাওয়া পাথরের বিগ্রহ স্থাপন করে তিনি শিষ্য রাজেন্দ্রনাথ চক্রবর্তীকে এই পবিত্র স্থানের সেবায়েত নিয়োগ করেন।তিনি দেবীকে প্রতিষ্ঠা করে তাঁর শিষ্য রাজেন্দ্রনাথ চক্রবর্তীকে ন্যাতরা থেকে ডেকে পাঠান এবং তাঁকে যাবতীয় দায়িত্ব সঁপে অন্যত্র চলে যান। এরপর রাজেন্দ্রনাথ চক্রবর্তীর বংশ বিস্তার ঘটতে থাকে এবং এই এলাকা পরিচিত হয় চক্রবর্তী পাড়া নামে। রাজেন্দ্রনাথ চক্রবর্তীর বংশ উত্তরাধিকার সূত্রে ধন্বন্তরি কালীর সেবায়েত হয়ে ওঠেন।

দেবী কালীর মহিমা বহুল প্রচলিত এবং শত শত বছর ধরে তিনি জাগ্রত। মন্দির থেকে স্বপ্নাদেশ পাওয়া বাত এবং অ্যাসিডিটির কবিরাজী ওষুধ প্রদান করা হয়। ঐ ওষুধ দেব বৈদ্য ধন্বন্তরী প্রদত্ত বলে বিশ্বাস করা হয়। রোগ নিরাময়ে দেবীর মাহাত্ম্য ভক্তদের কাছে দেবীকে ধন্বন্তরী করে তোলে।

 🧿 হিন্দু পুরাণ অনুসারে "ধন্বন্তরী" কে?

হিন্দু পুরাণ অনুযায়ী, ধন্বন্তরী হলেন চিকিৎসার দেবতা ও দেবরাজ বৈद्य। লোকবিশ্বাস, দেবী কালী তান্ত্রিক শক্তির মাধ্যমে অসুখ সারিয়ে তুলতেন। সেই কারণেই মা কালীর সঙ্গে যুক্ত হয়েছে "ধন্বন্তরী" নাম।

⚕️ কেন এই মন্দিরের নাম "ধন্বন্তরী"?
এই মন্দিরের দেবী কেবল পূজার অধিষ্ঠাত্রী নন, তিনি রোগ নিরাময়ের দেবী হিসেবেও পূজিত হন। স্থানীয় লোককথা অনুসারে, দেবীর আদেশে এক বিশেষ ভেষজ ওষুধ প্রস্তুত করে বহু রোগী সুস্থ হয়ে উঠেছিলেন। সেই ঐতিহ্য থেকেই দেবীর নামের সঙ্গে যুক্ত হয়েছে "ধন্বন্তরী" — চিকিৎসার দেবতার নাম।

ধন্বন্তরী কালীমন্দির, জয়নগর-মজিলপুর দক্ষিণ ২৪ পরগনা
 🕯️ মন্দির খোলা ও পূজার সময়সূচি:

🙏 প্রতিদিন মন্দির খোলা থাকে:
সকাল ৬টা থেকে দুপুর ১টা ।
বিকেল ৪টা থেকে রাত ৯টা।

🙏 প্রতিদিনের পূজা ও আরতির সময়সূচি:
সকাল: ৭:০০ – ৮:৩০ (মঙ্গল আরতি ও নৈবেদ্য)।
বিকেল: ৬:৩০ – ৭:৩০ (সন্ধ্যা আরতি)।

📅 বিশেষ দিন:
অমাবস্যা, মঙ্গলবার এবং শনিবারে ভক্তদের ভিড় সর্বাধিক থাকে।

🌟 বিশেষতা ও লোকবিশ্বাস:

👉 🕉️ জাগ্রত শক্তিপীঠ:
অনেক ভক্তের বিশ্বাস, মায়ের পূজায় সত্যিকারের সংকল্প করলে রোগমুক্তি বা মনস্কামনা পূর্ণ হয়।

👉 🌿 বিশেষ ওষুধ/প্রসাদ:
আগে এক ধরনের তেল বা ভেষজ দেওয়া হত, যেটি মা-র আশীর্বাদ বলে মনে করা হতো।

👉 🔮 তান্ত্রিক প্রথা:
মন্দিরে আজও কিছু তান্ত্রিক পূজা হয়, বিশেষ করে অমাবস্যা বা কালরাত্রিতে।

ধন্বন্তরী কালীমন্দির, জয়নগর-মজিলপুর দক্ষিণ ২৪ পরগনা
দক্ষিণ রায়, উচ্চতা: প্রায় ৩০ ইঞ্চি.
অবস্থান: ধন্বন্তরী কালীমাতা মন্দির,

🎊বৈশাখী 'বেশের মেলা': জয়নগরের এক অসাধারণ লোকউৎসব

🗓️ সময়: বৈশাখ মাসের শুক্লা প্রতিপদ থেকে এক পক্ষকাল (প্রথম ১৫ দিন)
📍 স্থান: ধন্বন্তরী কালীমাতা মন্দির, জয়নগর-মজিলপুর

প্রতিবছর বৈশাখ মাসের শুরুতেই ধন্বন্তরী কালীবাড়িতে শুরু হয় "বেশের মেলা"—এক অভিনব ধর্ম ও সংস্কৃতির মিলনক্ষেত্র। এই সময়ে দেবীকে প্রতিদিন একেকটি নতুন রূপে সাজানো হয়। কখনো মহাকালী, কখনো চণ্ডী, আবার কখনো কুমারী রূপে পূজিতা হন দেবী।

🎊 মেলার বিশেষত্ব:

🔸 প্রতিদিন সন্ধ্যা থেকে গভীর রাত পর্যন্ত চলে দর্শনার্থীর ঢল।
🔸 গড়ে প্রতিদিন ২৫-৩০ হাজার মানুষ, ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে, এই মেলায় অংশগ্রহণ করেন।
🔸 স্থানীয় ও বাইরের ব্যবসায়ীরা প্রায় ১০-১২ দিন আগে থেকে এসে মেলা চত্বরে দোকান সাজিয়ে তোলেন।
🔸 নানা ধরনের হস্তশিল্প, খাবার, খেলনা ও জয় রাইডে মুখরিত থাকে পুরো এলাকা।

🎭 লোকসংস্কৃতির প্রাণ:

🔹 স্থানীয় গায়েনদের পরিবেশনায় শোনা যায় তন্ত্রগান ও শ্মশান-কালী সংগীত।
🔹 শেষ দু'দিন চাঁদনিতে অনুষ্ঠিত হয় যাত্রানুষ্ঠান, যা স্থানীয় সংস্কৃতির এক গুরুত্বপূর্ণ অংশ।

🌼 শেষ দিনের পবিত্রতা:

বেশের মেলার শেষ দিনে দেবীর কুমারী রূপে পূজা হয়—এক বিশেষ তান্ত্রিক রীতি ও পবিত্র পরম্পরা, যা দর্শনার্থীদের হৃদয়ে এক গভীর আধ্যাত্মিক প্রভাব ফেলে।

ধন্বন্তরী কালীমন্দির, জয়নগর-মজিলপুর দক্ষিণ ২৪ পরগনা

🧱 মন্দিরের গঠন ও বিগ্রহ:

মন্দিরটি দক্ষিণমুখী এবং সমতল ছাদবিশিষ্ট। এখানে বিরাজমান দুইটি বিগ্রহ—একটি কালো পাথরের কালীমূর্তি এবং অপরটি নিমকাঠের তৈরি দেবী মূর্তি। দেবীর চার হাতে খাঁড়া, মুণ্ড, বর এবং অভয়মুদ্রা ধারণ করা হয়েছে, যা তান্ত্রিক রূপের প্রতীক।

ধন্বন্তরী কালীমন্দির, জয়নগর-মজিলপুর দক্ষিণ ২৪ পরগনা

এই দারুমূর্তি প্রতিষ্ঠা করেন রাজেন্দ্রনাথ চক্রবর্তী। পরবর্তীতে নির্মিত হয় মূল মন্দিরটি। মন্দিরের সম্মুখভাগে নির্মিত মনোরম চাঁদনীটি তৈরি করেন তাঁর বংশধর মথুরামোহন চক্রবর্তী।

ধন্বন্তরী কালীমন্দির, জয়নগর-মজিলপুর দক্ষিণ ২৪ পরগনা

🏛️ প্রধান মন্দির:
সমতল ছাদবিশিষ্ট, দক্ষিণমুখী, যা তার স্থাপত্য শৈলীতে স্থানীয় ঐতিহ্যের পরিচয় বহন করে।

👁️‍🗨️ বিগ্রহ:
কালো পাথরের কালীমূর্তি এবং নিমকাঠের মূর্তি, যাঁর হাতে খাঁড়া, মুণ্ড, বর এবং অভয়মুদ্রা দৃশ্যমান।

🌸 সামনের অংশ:
ফুলের বাগান, দীঘি, এবং পাকা চাতাল, যা মন্দিরের পরিবেশকে আরও পবিত্র ও আকর্ষণীয় করে তোলে।

🛣️ কিভাবে যাবেন?

🚆 ট্রেনে: শিয়ালদহ থেকে লক্ষ্মীকান্তপুর বা নামখানা লোকালে উঠে জয়নগর-মজিলপুর স্টেশনে নামুন।
🚶 হাঁটাপথ: স্টেশন থেকে মাত্র ৫ মিনিট হাঁটার দূরত্ব (১ নম্বর প্ল্যাটফর্মের দিক থেকে রেলগেট পেরিয়ে সোজা রাস্তা)।
🛺 টোটো/রিকশা: উপলব্ধ।

👬ধন্বন্তরী কালী মন্দির — 🧭G.P.S. নির্দেশিকা:

🌏 ঠিকানা: Kaikhali Road, Jaynagar, Jaynagar Majilpur, West Bengal 743372  
 🚩স্থানাঙ্ক - (Coordinates): 22°10′18.134″N, 88°25′15.042″E

🚉📍জয়নগর-মজিলপুর স্টেশন থেকে মাত্র ৭২০ মিটার দূরে, পায়ে হেঁটে মাত্র ১০ মিনিটের পথ। নিচের 🗺️ম্যাপটি ব্যবহার করে সহজেই পৌঁছে যান🚶‍♂️:

Post a Comment

0Comments

We welcome thoughtful discussions. Comments are moderated for quality

Post a Comment (0)

#buttons=(Ok, Go it!) #days=(20)

Our website uses cookies to enhance your experience. Check Now
Ok, Go it!