![]() |
সগড়াই গ্রামের ক্ষুদিরায়,মেঘরায় ও বাঁকুড়ারায় |
সগড়াই গ্রামের ইতিহাস ও ধর্মরাজের মন্দির
বর্ধমান-আরামবাগ রোড ধরে বর্ধমান শহর থেকে মাত্র ১০ কিলোমিটার পশ্চিমে অবস্থিত, পূর্ব বর্ধমানের খণ্ডঘোষ ব্লকে এই ঐতিহ্যবাহী গ্রাম। এখানে গ্রামের প্রধান দেবী হলেন সগড়াই চণ্ডী এবং ধর্মরাজ, যিনি স্থানীয়ভাবে ‘বাঁকুড়ারায়’ নামে পরিচিত।
এক সময় সগড়াই গ্রাম হুগলি জেলার উত্তরপাড়া জমিদারির অন্তর্ভুক্ত ছিল। প্রায় ১০০ বছর আগে জমিদার কৃষচন্দ্র ঘোষ ধর্মরাজের মাটির মন্দির ভেঙে নতুন পাকা মন্দির নির্মাণ করেন এবং মন্দিরের সামনে একটি নাটমন্দির গড়ে দেন। জমিদাররা পুজোর জন্য জমিও দান করেন। এক সিংহাসনে তিনটি শিলামূর্তি রয়েছে—ক্ষুদিরায়,মেঘরায় ও বাঁকুড়ারায়।বর্তমানে এখানে ধর্মরাজ ছাড়াও ক্ষুদিরায়, মেঘরায় ও মনসাদেবীর প্রতিমা পূজিত হয়।এটি বারো মতের গাজন, ১২ দিন ধরে গাজন উৎসব চলে।
ধর্মরাজের পরিচয় ও লোকবিশ্বাস
লোকধর্মে ধর্মরাজ এক গুরুত্বপূর্ণ দেবতা। গবেষকরা মনে করেন, ধর্মরাজ আসলে সূর্য, বরুণ, যমরাজ ও শিবের সংমিশ্রণে এক দেবত্ব লাভ করেছেন। যদিও সাধারণ ভক্তরা এসব বিশ্লেষণে যান না, তাঁদের কাছে ধর্মরাজ বিশ্বাস ও আস্থার প্রতীক। সেজন্যই আজও এই গ্রামে জলপড়া, তাবিজ, গাজনসহ নানা লোকাচার পালিত হয়।
ধর্মরাজ ও মনসাদেবীর বিয়ে উৎসব
দোল পূর্ণিমার সাত-আট দিন আগে থেকেই শুরু হয় গাজনের অনুষ্ঠান। দোলের দিন হয় প্রধান উৎসব এবং এই দিনই ধর্মরাজ ও মনসাদেবীর বিয়ে সম্পন্ন হয়।
বিয়ের প্রধান ধাপ:
✔ নিশিজল আনা : ভোরবেলায় নদী বা পুকুর থেকে জল আনা হয়।
✔ গায়ে হলুদ :দেবতার প্রতিমায় হলুদ দেওয়া হয়।
✔ স্নান ও পূজা :ধর্মরাজ, ক্ষুদিরায় ও মেঘরায়কে পুকুরে স্নান করানো হয়, তারপর পুজো করা হয়।
✔ বলিদান ও ফুল চাপানো :ছাগ বলি দিয়ে পূজা সম্পন্ন হয়।
✔ পালকিতে গ্রাম পরিক্রমা : সন্ধ্যায় ধর্মরাজের পালকি সারা গ্রাম পরিক্রমা করে মন্দিরে ফিরে আসে।
✔ বিয়ের অনুষ্ঠান : রাতে মন্দিরের সামনের নাটমন্দিরে ধর্মরাজ ও মনসাদেবীর বিয়ে হয়।
লোকগান ও বিয়ের ছড়া
এই বিয়ের অন্যতম আকর্ষণ পরামানিক ছড়া। মালাবদলের সময় নাপিত ও পুরোহিতরা ছড়া বলেন, যা লোকসংস্কৃতির এক অমূল্য নিদর্শন।
🔹 উদাহরণ:
"অংশ প্রণাম করি ব্রাক্ষ্মণ চরণে,
শত শত নমস্কার সভাসদগণে।
মহাদেবের বিয়ের কথা অপূর্ব কথন,
বাস করি আমি দিন সগরাই গ্রাম,
ছড়াকার কার্তিক আমার নাম।"
সগড়াই গ্রামের লোকসংস্কৃতি ও তার প্রভাব
এখানের মানুষদের কাছে ধর্মরাজ ও মনসা শুধুই দেবতা নন, তাঁরা পরিবারের সদস্যের মতো। তাই বিয়ের কার্ড ছাপানো, নিমন্ত্রণ প্রথা, বরণডালা সাজানো, পাটাবদল করা—সবকিছুই এক বিশাল সাংস্কৃতিক উৎসবের রূপ নেয়।
উৎসবের পরবর্তী আয়োজন
দোলের পরদিন প্রীতিভোজ ও গাজনের নানা অনুষ্ঠান অনুষ্ঠিত হয়, যেখানে স্থানীয় লোকগান, ধূপ-ধুনো পোড়ানো, দণ্ডিকাটা ইত্যাদি আয়োজিত হয়।
![]() |
ভোলানাথ পণ্ডিত |
সগড়াই গ্রামের ধর্মরাজ ও মনসাদেবীর বিয়ে কেবল একটি ধর্মীয় অনুষ্ঠান নয়, এটি বাংলার লোকসংস্কৃতির এক গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায়। এই উৎসবের মধ্য দিয়ে আমরা বাংলার লোকাচার ও বিশ্বাসের এক সমৃদ্ধ চিত্র দেখতে পাই।
Asadhran asadhran asadhran sundor
উত্তরমুছুন