![]() |
যুগল কিশোর বিগ্রহ |
পশ্চিমবঙ্গের নদীয়া জেলার আড়ংঘাটায় অবস্থিত যুগল কিশোর মন্দির কেবল একটি ধর্মীয় স্থাপনা নয়, এটি একটি ঐতিহাসিক ও সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যের প্রতীক। এখানে প্রতি বছর জ্যৈষ্ঠ মাসে জামাইষষ্ঠী উপলক্ষে মিলন মেলা বসে, যা স্থানীয় বাসিন্দাদের পাশাপাশি দূর-দূরান্ত থেকে আসা ভক্তদের মন আকর্ষণ করে। এই মন্দিরের সাথে জড়িয়ে আছে শ্রীকৃষ্ণ ও রাধার মিলনের এক অনন্য কাহিনি, যা আজও পূজার্চনা ও লোকবিশ্বাসের মাধ্যমে জীবন্ত হয়ে আছে।
মন্দিরের দরজা খোলার নিয়ম
এই মন্দিরে পাঁচটি গৃহ রয়েছে, এবং প্রতিটি বিগ্রহের জন্য আলাদা আলাদা দরজা ও কক্ষ রয়েছে। তবে বর্তমানে যুগলকিশোরের সঙ্গেই সমস্ত বিগ্রহ পূজিত হন।ভক্তদের জন্য দর্শনের জন্য মন্দিরের গর্ভগৃহের দরজা নির্দিষ্ট সময়ে খোলা হয়:
- মন্দির সকাল ৬:৩০-এ খোলে।
- সকাল ১০:৩০ নাগাদ ভোগ নিবেদন করা হয়।
- সকাল ১১:০০ টায় ভোগ আরতি সম্পন্ন হওয়ার পর গর্ভগৃহের দরজা বন্ধ হয়ে যায়।
- দুপুর ২:৩০-এ পুনরায় গর্ভগৃহের দরজা খোলা হয়।
- সন্ধ্যায় হরিনাম সংকীর্তন ও সন্ধ্যা আরতি অনুষ্ঠিত হয়, এবং রাত ৮:০০ পর্যন্ত মন্দির খোলা থাকে।
তবে, মন্দিরের প্রধান প্রবেশদ্বার সারাদিন খোলা থাকে। জ্যৈষ্ঠ মাসের বিশেষ অনুষ্ঠানের সময় পাঁচটি দরজা খোলা হয়।
![]() |
শিলাখণ্ড গুলি মা ষষ্ঠী দেবী রূপ |
গর্ভগৃহের পাঁচটি দরজার বিগ্রহ বিন্যাস:
- দক্ষিণ দিকের দরজায় গোপীনাথ
- দ্বিতীয় দরজায় রাধাবল্লভ
- তৃতীয় দরজায় যুগলকিশোর
- চতুর্থ দরজায় কালাচাঁদ
- পঞ্চম দরজায় শ্যামচাঁদ
যুগল কিশোর মন্দির
এই মন্দিরের উৎপত্তির পেছনে রয়েছে এক চমকপ্রদ কাহিনি। আনুমানিক ১৭২৮ সালে নদিয়ার রাজা কৃষ্ণচন্দ্র রায়ের সহযোগিতায় এই মন্দিরটি নির্মিত হয়।যদিও মন্দিরটি রাজা কৃষ্ণচন্দ্র প্রতিষ্ঠা করেছিলেন, পরবর্তী সময়ে এটি বহুবার সংস্কার করা হয়েছে।
🔹 গঙ্গারাম দাসের বৃন্দাবন থেকে আগমন:
একজন বৈষ্ণব মহান্ত গঙ্গারাম দাস, বৃন্দাবন থেকে একটি কিশোর গোপীনাথের মূর্তি এনে নবদ্বীপের কাছে সমুদ্রগড়ে পূজার্চনা করতে থাকেন।
🔹 বর্গী হামলা ও মূর্তির স্থানান্তর:
কিছুদিন পরে সমুদ্রগড়ের এক প্রান্তে বর্গীরা আক্রমণ করলে, গঙ্গারাম দাস কিশোর গোপীনাথকে নিয়ে জল-পথ পার হয়ে আড়ংঘাটায় আসেন। মহারাজ কৃষ্ণচন্দ্রের সৈনিক রামপ্রসাদের কাছে আশ্রয় চান।
রামপ্রসাদ এঘাটে, একটি চালা ঘর তৈরি করে গোপীনাথ জিউর মূর্তি প্রতিষ্ঠা ও নিত্য সেবার ব্যবস্থা করেন।
একদিন গঙ্গারাম স্বপ্নে দেখলেন কিশোর গোপীনাথ বলছেন, “আমার রাধিকা আছে মহারাজ কৃষ্ণচন্দ্রের কাছে।” গঙ্গারাম এ কথা মহারাজকে জানালে, মহারাজ চিন্তিত মনে বলেন, "রাধিকা তো আমার কাছে নেই।
🔹 রাধার মূর্তি আবিষ্কার ও যুগল কিশোরের জন্ম:
একদিন রাজা কৃষ্ণচন্দ্র স্বপ্নাদেশ পান যে, তার রাজপ্রাসাদের ভূগর্ভে রাধার মূর্তি রয়েছে। ভূগর্ভ থেকে মহারাজ রাধিকার মূর্তি খুঁজে পেয়ে নৌকা-বিহারে এসে বৈষ্ণব মহান্ত গঙ্গারামের হাতে তুলে দেন।
জনশ্রুতি অনুযায়ী, রাধাকে কন্যা ও গোপীনাথ কৃষ্ণকে জামাই হিসাবে প্রতিষ্ঠা করে। গোপীনাথ ও রাধিকার মূর্তি দুটির একসাথে নামকরণ করা হলো "যুগল কিশোর"।
![]() |
শানবাঁধানো ঘাট |
মন্দিরের পিছনে চূর্ণী নদী বয়ে গেছে,সেইখানে বর্তমানে রয়েছে শানবাঁধানো ঘাট। জানা যায়, এই ঘাটে নদিয়া রাজা কৃষ্ণচন্দ্র রাধিকাকে নিয়ে বজরা নৌকা থেকে নেমেছিলেন।
মন্দির চত্বরে প্রায় ৩০০ বছরের পুরোনো এক বিশাল বকুল গাছ রয়েছে, যা ‘সিদ্ধ বকুল’ বা ‘কল্পতরু’ গাছ নামে পরিচিত।
![]() |
প্রাচীন বকুল গাছ |
এই গাছের নিচে মহারাজ গোপীনাথ ও রাধিকার মিলন ঘটিয়েছিলেন রাজব্রাহ্মণ পণ্ডিতদের দ্বারা। মহা আড়ম্বরে পূজার্চনা করান এবং যুগল কিশোরের পূজাপাঠের জন্য ১২৫ বিঘা নিষ্কর জমি দান করেন।
🌿 বিশ্বাস ও ধর্মীয় রীতি:
প্রচলিত লৌকিক বিশ্বাস অনুযায়ী, জ্যৈষ্ঠ মাসে যুগল কিশোরের দর্শন করে প্রার্থনা করলে এই জন্মে এমনকি পরের জন্মেও বৈধব্য দশা ভোগ করতে হয় না।
🌿 ঢেলা বাঁধার রীতি:
প্রাচীন বকুল গাছটিকে "সিদ্ধবকুল" বা "কল্পতরু" মনে করে পূজা করা হয়।স্থানীয় বিশ্বাস অনুযায়ী, তরুণীরা এই বকুল গাছে ঢেলা (পাথর) বাঁধেন পতি লাভের আশায় প্রার্থনা করেন, এবং মনস্কামনা পূরণ হলে সেই ঢেলা খুলে পুজো দেন।
ভক্তদের জন্য প্রসাদের ব্যবস্থা রয়েছে। প্রসাদ গ্রহণের জন্য আগের দিন ৯৭৩৫৪৩৪৫৭৯ নম্বরে ফোন করে যোগাযোগ করতে হবে।
![]() |
সন্ধ্যায় হরিনাম সংকীর্তন ও সন্ধ্যা আরতি অনুষ্ঠিত |
জামাই ষষ্ঠী ও মিলন মেলা
🔸 লোকশিল্প ও সঙ্গীত:
- বাউল ও লোকসঙ্গীত পরিবেশিত হয়।
- বিভিন্ন গ্রাম্য শিল্পীরা গান, নাচ ও নাটকের আসর বসান।
🔸 বিপুল জনসমাগম ও ব্যবসা-বাণিজ্য:
- এই মেলায় স্থানীয় ব্যবসায়ীরা বিভিন্ন ধরণের দোকান নিয়ে হাজির হন।
- পিঠেপুলি, মাটির জিনিস, হস্তশিল্প ও খেলনা অন্যতম আকর্ষণ।
![]() |
স্থাপত্য ও আর্কিটেকচার |
মন্দিরের স্থাপত্য ও আর্কিটেকচার:যুগল কিশোর মন্দিরের স্থাপত্য শৈলী বাংলা ও বৈষ্ণব সংস্কৃতির সংমিশ্রণ।মন্দিরটি পূর্বমুখী। মন্দিরের ভেতরে ও বাইরে পঙ্খের (শঙ্খের) কারুকাজ করা আছে এবং বিভিন্ন দেব-দেবীর মূর্তি রয়েছে।
✔ পাঁচটি বিশাল খিলান ও থাম যুক্ত বারান্দা
✔ নান্দনিক পালিশ করা পাথরের কারুকাজ
✔ মন্দিরের দেওয়ালে পঙ্খ অলংকরণের সুন্দর কাজ
✔ কৃষ্ণ ও রাধার পাশাপাশি শালগ্ৰাম শিলা, বলরাম, রেবতী, কালাচাঁদ, গোপীনাথসহ আরও বহু মূর্তি পূজিত হয়।
এখানে রথযাত্রা হয়।এই মন্দিরের পিছনের দিকে, বাঁদিকের গলি দিয়ে বৈষ্ণব মহান্তের বাসস্থানে প্রবেশ করা যায়, এবং সেখানে গরু প্রতিপালন করা হয়। একদম পিছনে চূর্ণীর বাঁধানো ঘাটে পৌঁছাতে বাঁদিকে শিবলিঙ্গ বিরাজমান একটি মন্দির রয়েছে।
![]() |
চূর্ণীর ঘাটে যেতে বাঁদিকে শিব মন্দিরের লিঙ্গ রয়েছে। |
কৃষ্ণচন্দ্র রায় ও যুগল কিশোর মন্দির
কীভাবে যাবেন যুগল কিশোর মন্দির?
🔹 নিকটতম রেলস্টেশন: আড়ংঘাটা রেলস্টেশন।
🔹 সড়কপথ: কলকাতা বা নদীয়া জেলার বিভিন্ন স্থান থেকে বাস ও টোটো পরিষেবা উপলব্ধ।
🔹 স্টেশন থেকে দূরত্ব: মাত্র ১০ মিনিট হাঁটলেই মন্দিরে পৌঁছানো যায়।
আপনি যদি বাংলার প্রাচীন ঐতিহ্য ও লোকবিশ্বাস সম্পর্কে জানতে চান, তাহলে একবার এই মন্দির দর্শনে আসতেই পারেন। মন্দিরের ইতিহাস, পূজার্চনা ও সংস্কৃতির সৌন্দর্য আপনাকে মুগ্ধ করবে।
![]() |
যুগল কিশোর মন্দিরের বর্তমান সেবায়েতের সাক্ষাৎকার |
📝 তথ্যসূত্র:
- যুগল কিশোর মন্দিরের বর্তমান সেবায়েতের সাক্ষাৎকার
- স্থানীয় ইতিহাসবিদ ও গবেষণা সংকলন
- উইকিপিডিয়া ও নদীয়া জেলার পুরাতাত্ত্বিক তথ্যভান্ডার
📢 আপনার অভিজ্ঞতা আমাদের জানান! মন্দির পরিদর্শনের পর কেমন লাগলো? কমেন্টে লিখে জানান!
We welcome thoughtful discussions. Comments are moderated for quality