দেবী চৌধুরাণী: ইতিহাস, রূপকথা ও এক রহস্যময়ী নারীর অজানা কাহিনি
দেবী চৌধুরাণী - একটি নাম, যা বাংলার ইতিহাস ও লোককথায় এক রহস্যময় আবরণ তৈরি করেছে। বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের অমর সৃষ্টি হলেও, এই মহীয়সী নারীর জীবন সত্যিই রূপকথা আর বাস্তবের এক জটিল মিশ্রণ। ভবানী পাঠকের সহযোগী হিসেবে পরিচিত এই ব্যক্তিত্বের জীবন আজও গবেষণার বিষয়। চলুন, জেনে নিই বাংলার এই কিংবদন্তী নারীর অজানা কিছু তথ্য।
প্রারম্ভিক জীবন ও রহস্যময়ী পরিচিতি
দেবী চৌধুরাণীর জন্মস্থান বর্তমান বাংলাদেশের রংপুর জেলার বাজপুর গ্রামে। তাঁর শৈশব ও কৈশোরের গল্পগুলো কিংবদন্তীর মতো শোনালেও, বঙ্কিমচন্দ্রের লেখনীতে তিনি এক অমর চরিত্র হয়ে আছেন। ভবানী পাঠকের সহযোগী হিসেবে তাঁর আত্মপ্রকাশ বাংলার ইতিহাসে এক নতুন অধ্যায় উন্মোচন করে। তাঁর জীবন ঘিরে থাকা রহস্যময়তা আজও অনেক প্রশ্নের জন্ম দেয়, যা গবেষকদের আজও আকর্ষণ করে।
রংপুর বিদ্রোহে দেবী চৌধুরাণীর ভূমিকা
১৭৮৩ খ্রিষ্টাব্দে সংঘটিত রংপুর বিদ্রোহ ইতিহাসে এক গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায়। বিশ্বকোষে উল্লেখ আছে যে, রাজা দেবী সিংহের কর সংগ্রহের নামে প্রজাদের ওপর অত্যাচারের ফলস্বরূপ এই বিদ্রোহের সূত্রপাত ঘটে। বিদ্রোহীরা "বিখ্যাত ডাকাত দল" নামে পরিচিত হলেও, তাঁরা আসলে অত্যাচারের বিরুদ্ধে সংগ্রামকারী ছিলেন। মন্থনার জমিদার, জয়দুর্গাদেবী নামে এক বুদ্ধিমতী ও তেজস্বিনী রমণীই এই বিদ্রোহের নেতৃত্ব দিয়েছিলেন।
ডিমলার জমিদার গৌরমোহন চৌধুরী বিদ্রোহীদের বাধা দিতে গিয়ে প্রাণ হারান। এর ফলে কাকিনা, টেপা, কাজির হাট এবং ফতেপুর পরগণায় কর সংগ্রাহকদের হত্যা করা হয়। যদিও এই ঘটনাগুলির সাথে লুটপাট ও নরহত্যা জড়িত ছিল, ইতিহাসে এই বিদ্রোহীদের পরবর্তীতে "ডাকাত" হিসেবে চিহ্নিত করা হয়। পরে এই বিদ্রোহকে সন্ন্যাসী বিদ্রোহ-এর অংশ হিসেবে গণ্য করা হয়।
শিকারপুর মন্দিরে দেবী চৌধুরানী পূজা
জলপাইগুড়ির শিকারপুরের মানুষের কাছে দেবী চৌধুরাণী কেবল একজন ঐতিহাসিক চরিত্র নন, তিনি আক্ষরিক অর্থেই দেবী রূপে পূজিতা হয়ে আসছেন। প্রতি বছর কালীপূজোর অমাবস্যা রাতে দেবী চৌধুরাণী এবং ভবানী পাঠকের মূর্তি কালীমূর্তির পাশে বসিয়ে পূজা করা হয়। প্রায় দুশো বছর ধরে এই ঐতিহ্যবাহী পূজা অনুষ্ঠিত হয়ে আসছে, যেখানে দেবী চৌধুরাণী ও ভবানী পাঠকের নামেই পূজার সংকল্প করা হয়। এটি লোকবিশ্বাসে তাঁদের প্রতি গভীর শ্রদ্ধা ও ভক্তিরই প্রতিফলন।
গবেষণা ও ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপট
গবেষক উমেশ শর্মার মতে, বঙ্কিমচন্দ্রের কালজয়ী উপন্যাস 'দেবী চৌধুরাণী'-এর প্রফুল্ল চরিত্রটিই দেবী চৌধুরাণীর প্রতিরূপ। ভবানী পাঠক ছিলেন প্রকৃত সন্ন্যাসী, এবং উপন্যাসের ব্রজেশ্বর চরিত্রটি বাস্তবের রাজা দর্পদেবের প্রতিরূপ। এমনকি দেবী চৌধুরাণীর সহচরী দিবা ও নিশিও বাস্তব চরিত্র ছিলেন বলে মনে করা হয়।
প্রায় ২৭৫ বছর আগে যখন ইংরেজরা বৈকুণ্ঠপুরের রাজা দর্পদেবকে তাঁর রাজ্য থেকে সরিয়ে দেওয়ার চেষ্টা করে, তখন রংপুরের মন্থনী রাজ্যের জমিদারবাড়ির পুত্রবধূ জয়দুর্গাদেবী চৌধুরাণী তাঁকে সহযোগিতা করেন। ভবানী পাঠকও এই সংগ্রামে তাঁর সাথে শামিল হন।
সশস্ত্র সংগ্রাম এবং লোকবিশ্বাস
দেবী চৌধুরাণীর নেতৃত্বে একটি বিশাল সশস্ত্র দল ছিল। তিনি ত্রিস্রোতা (তিস্তা) নদী দিয়ে তাঁর বজরায় যাতায়াত করতেন, যা তাঁর পরাক্রমের এক প্রতীক ছিল। শিকারপুরের স্থানীয় মানুষের বিশ্বাস, দেবী চৌধুরাণী এবং ভবানী পাঠক দুজনেই ঈশ্বরের অবতার হিসেবে বাংলার মানুষের রক্ষার্থে পৃথিবীতে এসেছিলেন। তাঁদের এই লোকগাঁথা আজও মানুষের মুখে মুখে ফেরে, যা তাঁদের চরিত্রকে আরও মহিমান্বিত করে তোলে।
উপসংহার: কালীপূজোর দিনে শিকারপুরের মন্দিরে আজও অসংখ্য ভক্তের ভিড় দেখা যায়, যারা দেবী চৌধুরাণী ও ভবানী পাঠককে শ্রদ্ধা জানাতে আসেন। দেবী চৌধুরাণীর জীবনের ইতিহাস এবং রূপকথা এতটাই মিশ্রিত যে তিনি আজও বাংলার এক রহস্যময় এবং আকর্ষণীয় ব্যক্তিত্ব হিসেবে সমাদৃত। তাঁর সংগ্রাম, সাহস এবং লোকবিশ্বাসের সংমিশ্রণ তাঁকে অমর করে রেখেছে।
We welcome thoughtful discussions. Comments are moderated for quality