পুরুলিয়ার টুসু উৎসব ও শিলাবতী পরব: এক বর্ণময় লোকউৎসব

পুরুলিয়ার টুসু উৎসব ও শিলাবতী পরব: এক বর্ণময় লোকউৎসব

লালপেঁচা.in – বাংলার না-বলা কথা
0

purulia-tour.jpg
পুরুলিয়ার টুসু উৎসব ও শিলাবতী পরব: এক বর্ণময় লোকউৎসব
  জানুয়ারি মাসের ঠান্ডা সকাল। আমরা শুরু করলাম আমাদের যাত্রা রুলিয়া থেকে। হুড়া-পুরুলিয়া রোড ধরে চলতে চলতে পৌঁছালাম লালপুর বাসস্ট্যান্ড। এখান থেকে ডান দিকের রাস্তা চলে গিয়েছে হুড়ার দিকে। সেই পথ ধরেই বড়গ্রাম হাই স্কুল পেরিয়ে কিছুটা এগোতেই দেখা মেলে শিলাবতী মাতার মন্দির ও মেলার মাঠ। প্রায় ৩৭ কিলোমিটার পথ অতিক্রম করে ঘণ্টাখানেকের মধ্যে আমরা পৌঁছালাম।

আজ পৌষ সংক্রান্তি, মকর পর্ব। সমগ্র পুরুলিয়া যেন উৎসবের আনন্দে ভাসছে। এই দিনটিকে ঘিরে জাগে টুসু পূজার প্রাণ। অঘ্রাণ সংক্রান্তিতে মাটির গাত্রে গোবর, সিঁদুর, কাজলের টিপ ও চালের গুঁড়ো দিয়ে তৈরি হয় টুসুর আসন। এই লৌকিক দেবীর আরাধনা চলে পৌষের শেষ দিন পর্যন্ত, এবং সংক্রান্তির দিন তার বিসর্জন হয়। টুসু মূলত এক লৌকিক দেবী। তাকে কেন্দ্র করেই এই উৎসব অনুষ্ঠিত হয়। পুরুলিয়ার টুসু উৎসব শুধু একটি ধর্মীয় উৎসব নয়, এটি এই অঞ্চলের মানুষের সংস্কৃতি আর ঐতিহ্যের প্রতিচ্ছবি।

টুসু উৎসবের ইতিহাস

টুসু উৎসবের ইতিহাস বেশ পুরনো। মনে করা হয়, কোল গোষ্ঠীর 'টুসা' (টুসাই) থেকে 'টুসু' নামটি এসেছে। কোল ভাষায় টুসা-র অর্থ, ফুলের গুচ্ছ। গ্রামীণ পুরুলিয়ায় এক মাস ধরে প্রতি সন্ধ্যায় টুসু বন্দনা করা হয়। টুসুগান গেয়ে দেবীর আরাধনা করেন মহিলারা। পৌষ সংক্রান্তির আগের দিন উপবাস করে, সারা রাত জেগে টুসুর আরাধনা করা হয়। ঘরে ঘরে তৈরি হয় পিঠে-পুলি।

শিলাই নদী ও মেলার ইতিহাস

শিলাই নদীর উৎপত্তি পুরুলিয়া জেলার হুড়া থানার বড়গ্রাম অঞ্চলে। পৌষ সংক্রান্তির দিনে এই নদীর পাড়ে বসে বিশাল মেলা। এ বছর মেলার ৮৩তম বর্ষ। মেলার আয়োজক শ্রীশ্রী শিলাবতী পঞ্চগ্রামীণ মেলা কমিটি। মেলার মূল আকর্ষণ টুসুর চৌডোলা নিয়ে নাচের প্রতিযোগিতা। বিজয়ীদের জন্য থাকে আর্থিক পুরস্কার।

মেলার আরেকটি বিশেষ অনুষ্ঠান হলো নবম কুণ্ডীয় গায়ত্রী মহাযজ্ঞ। পয়লা মাঘে শুরু হয় আখ্যান যাত্রা ও কুমারীদের দিব্য কলস যাত্রা। পুরো মেলা ৯-১০ দিন ধরে চলে, যেখানে বাউল গান, অষ্টপ্রহর হরিনাম সংকীর্তন এবং অন্যান্য সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান হয়।

টুসু উৎসব: এক মহিমাময় গ্রামীণ সংস্কৃতি

টুসু পুরুলিয়া, বাঁকুড়া, বীরভূম, পশ্চিম বর্ধমান, ঝাড়গ্রাম থেকে শুরু করে ঝরিয়া, রাঁচি, ধানবাদ, হাজারিবাগ প্রভৃতি অঞ্চলের এক জনপ্রিয় লৌকিক উৎসব। কোল সম্প্রদায়ের ‘টুসা’ শব্দ থেকে সম্ভবত ‘টুসু’ নামটির উৎপত্তি, যার অর্থ ফুলের গুচ্ছ।

পুরুলিয়ার গ্রামেগঞ্জে এক মাস ধরে প্রতি সন্ধ্যায় টুসু বন্দনা চলে। মহিলারা সমবেত কণ্ঠে গেয়ে ওঠেন টুসুগান—

“টুসু পূজার ক্ষণে,
সন্ধ্যাদেবী বন্দি গো মনে মনে,
লক্ষ্মীদেবী বন্দি গো শ্রীচরণে।”

পৌষ সংক্রান্তির আগের দিন মহিলারা উপবাস করেন, সারা রাত জেগে টুসু পূজার আয়োজন করেন। ঘরে ঘরে তৈরি হয় পিঠে-পুলি।

সংক্রান্তির দিন টুসুর আসন সাজানো হয় রঙিন কাগজ দিয়ে। সাজানো চৌডোলা বা চতুর্দোলায় বসিয়ে টুসুকে নিয়ে যাওয়া হয় স্থানীয় নদী বা পুকুরে বিসর্জনের জন্য। শিলাই নদীর উৎসস্থলে প্রতি বছর বসে এই টুসু বিসর্জনের মেলা, যা শিলাই পরব নামে পরিচিত।

 

শিলাবতী মাতার মন্দির ও মেলার বিশেষত্ব:

সংক্রান্তিতে রঙিন কাগজে চতুর্দোলা বা চৌডোলা সাজিয়ে তাতে টুসুকে নিয়ে যাওয়া হয় নিকটবর্তী কোনও জলাধারে, বিসর্জন দিতে। লৌকিক দেবী টুসুর বিসর্জন উপলক্ষে মেলা বসে পুরুলিয়ার বিভিন্ন জায়গায়। এর মধ্যে অন্যতম বিখ্যাত মেলা হল শিলাবতী পরব।

শিলাই বা শিলাবতী নদীর ধারে এই মেলা বসে। শিলাবতী নদীর উৎপত্তি পুরুলিয়া জেলার হুড়া থানার বড়গ্রাম অঞ্চলে। প্রতি বছর পৌষ সংক্রান্তিতে নদীর উৎসস্থলে বসে টুসু বিসর্জনের মেলা। এই মেলাই পরিচিত শিলাই পরব নামে। রকমারি জিনিসের পশরা সাজিয়ে বসেন বিক্রেতারা। প্রচুর মানুষের সমাবেশ হয়।

শিলাই নদীর উৎসস্থলে রয়েছে চারটি মন্দির।

  1. প্রথম মন্দিরটি নির্মাণ করেছিলেন বড়গ্রামের গিরিশ মাহাত।
  2. দ্বিতীয় মন্দিরটি নির্মাণ করেন মিলন তীর্থ সমিতি, এটি হরিনাম সংকীর্তনের জন্য।
  3. তৃতীয় মন্দিরটি শিবকে উৎসর্গ করে নির্মাণ করেন অতুলচন্দ্র মাহাত।
  4. চতুর্থ মন্দিরটি শিলাবতী মাতার। এই মন্দিরটি প্রতিষ্ঠা করেন শঙ্কর রাজোয়াড়।বড়গ্রামের বিজয় রাজোয়াড়ও একটি শিলাবতী মাতার মন্দির নির্মাণ করেন।

এ বছর শিলাইয়ের পাড়ে টুসু বিসর্জনের মেলার ৮৩তম বর্ষ। মেলার উদ্যোক্তা শ্রীশ্রীশিলাবতী পঞ্চগ্রামীণ মেলা কমিটি। টুসু বিসর্জনকে কেন্দ্র করে তাঁরা আয়োজন করেন নানা সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের। টুসুকে ভাসানোর আগে চৌডোলায় বসিয়ে এক বিশেষ ধরনের নাচের প্রতিযোগিতা হয়। প্রথম, দ্বিতীয় ও তৃতীয় স্থানাধিকারীর জন্য থাকে আর্থিক পুরস্কার। সংক্রান্তির পরের দিন অর্থাৎ পয়লা মাঘ আখ্যান যাত্রা উপলক্ষে নবম কুণ্ডীয় গায়ত্রী মহাযজ্ঞ গ্রাম পরিক্রমা আয়োজিত হয়। কেবল কুমারী মেয়েরা দিব্য কলস যাত্রায় বেরন। ৯-১০ দিন ধরে চলা মেলায় বাউল গান ও অষ্টপ্রহর হরিনাম সংকীর্তনেও ভিড় হয় উৎসাহী মানুষের।

 মেলায় কেনাকাটা ও লোকজ সংস্কৃতি

শিলাই মেলা মানেই গ্রামীণ হস্তশিল্প ও খাবারের বাজার। মেলায় পাওয়া যায় রকমারি হস্তনির্মিত সামগ্রী, পিঠে-পুলি, গয়না, মাটির পুতুল, বাঁশের তৈজসপত্র ইত্যাদি। চারদিকে লোকগানের সুর আর মানুষের কোলাহল মিলে এক উৎসবমুখর পরিবেশ তৈরি হয়।

কীভাবে যাবেন পুরুলিয়া:

কলকাতার দিক থেকে পুরুলিয়া যাওয়ার জন্য রয়েছে বেশ কিছু ট্রেন। হাওড়া থেকে পুরুলিয়ার উদ্দেশ্যে একাধিক ট্রেন চলাচল করে। উদহারণ :

  1. হাওড়া-রাঁচি বন্দে ভারত এক্সপ্রেস: দুপুর ২:৩৫-এ ছাড়ে, সন্ধ্যা ৭:২৩-এ পুরুলিয়া পৌঁছায়।
  2. রূপসী বাংলা এক্সপ্রেস: সাঁতরাগাছি থেকে ভোর ৬:২৮-এ ছাড়ে, দুপুর ১২:০৫-এ পৌঁছায়।
  3. হাওড়া-চক্রধরপুর এক্সপ্রেস: রাত ১১:৩৫-এ ছাড়ে, পরদিন ভোর ৬:৩০-এ পৌঁছায়।

 আপনি আপনার সুবিধা অনুযায়ী যেকোনো একটি বেছে নিতে পারেন।

  পুরুলিয়ায় থাকার জায়গা:

পুরুলিয়ায় থাকার জন্য বিভিন্ন ধরনের যুব আবাস ও হোটেল রয়েছে। আপনি চাইলে যুব আবাসে থাকতে পারেন অথবা কোনো বেসরকারি হোটেলেও থাকতে পারেন। আপনার বাজেট অনুযায়ী আপনি যেকোনো একটি বেছে নিতে পারেন।যেমন :

  • পুরুলিয়া যুব আবাস: নন-এসি চারশয্যা ঘরের ভাড়া ৯০০ টাকা।
  • পুরুলিয়া জয়চণ্ডী পাহাড় যুব আবাস: নন-এসি দ্বিশয্যা ঘরের ভাড়া ৫৫০-৬০০ টাকা।
  • অযোধ্যা পাহাড় যুব আবাস: নন-এসি তিনশয্যা ঘরের ভাড়া ৮২৫ টাকা।

এছাড়া সরকারি ওয়েবসাইট থেকে ইকো ট্যুরিজমের বুকিং করা যায়। প্রাইভেট হোটেলের মধ্যে হোটেল আকাশ সরোবর এবং হোটেল পিনাকী সদন উল্লেখযোগ্য।

 

কিছু প্রয়োজনীয় তথ্য:আজকের দিনে

  • পুরুলিয়া যুব আবাস: নন-এসি চারশয্যা ঘরের ভাড়া ৯০০ টাকা। এসি দ্বিশয্যা ঘরের ভাড়া ৮০০ টাকা। এসি তিনশয্যা ঘরের ভাড়া ১,০২৫ টাকা, ডর্মিটরি শয্যাপ্রতি ২২৫ টাকা।
  • পুরুলিয়া জয়চণ্ডী পাহাড় যুব আবাস: নন-এসি একশয্যা ঘরের ভাড়া ৪২৫ টাকা। নন-এসি দ্বিশয্যা ঘরের ভাড়া ৫৫০-৬০০ টাকা, নন-এসি তিনশয্যা ঘরের ভাড়া ৮২৫ টাকা, এসি দ্বিশয্যা ঘরের ভাড়া ৮৫০ টাকা, এসি চারশয্যা ঘরের ভাড়া ১,৩০০ টাকা, ভিআইপি ঘরের ভাড়া ১,৪০০-১,৭০০ টাকা, ডর্মিটরি শয্যাপ্রতি ২২৫ টাকা।
  • পুরুলিয়া অযোধ্যা পাহাড় যুব আবাস: নন-এসি দ্বিশয্যা ঘরের ভাড়া ৬০০-৭৫০ টাকা, নন-এসি তিনশয্যা ঘরের ভাড়া ৮২৫ টাকা, নন-এসি চারশয্যা ঘরের ভাড়া ১,১০০ টাকা, এসি দ্বিশয্যা ঘরের ভাড়া ৯৫০ টাকা, এসি তিনশয্যা ঘরের ভাড়া ১,২২৫ টাকা, এসি চারশয্যা ঘরের ভাড়া ১,৫০০ টাকা, এসি ডিলাক্স দ্বিশয্যা ঘরের ভাড়া ১,১০০ টাকা, ভিআইপি ঘরের ভাড়া ১,৫৫০ টাকা, ডর্মিটরি শয্যাপ্রতি ২২৫ টাকা। ওয়েবসাইট: https://youthhostelbooking.wb.gov.in
  • পশ্চিমবঙ্গ সরকারের পঞ্চায়েত ট্যুরিজমের অধীনে ডব্লিউ বি সি এ ডি সি, অযোধ্যা হিল প্রোজেক্ট: নন-এসি দ্বিশয্যা ঘরের (নন-অ্যাটাচড বাথ) ভাড়া ৭০০ টাকা, এসি দ্বিশয্যা ঘরের ভাড়া ১,৫০০ টাকা, এসি তিনশয্যা ঘরের ভাড়া ১,৮০০ টাকা এবং ডর্মিটরি ৪০০ টাকা।
  • কুমারি কানন ইকো ট্যুরিজম, অযোধ্যা হিল প্রোজেক্ট: মাড হাউসের ভাড়া ১,০০০ টাকা এবং ফ্যামিলি কটেজের ভাড়া ১,৮০০ টাকা।  ওয়েবসাইট: https://prdtourism.wb.gov.in
  • প্রাইভেট হোটেল: হোটেল আকাশ সরোবর (৪৮০০১৯-০১৯০১), ব্রেকফাস্ট সহ ভাড়া ২,৫০০-৩,০০০ টাকা। ট্যাক্স অতিরিক্ত।
  • হোটেল পুরুলিয়া ইন (৯৭৩৫৪-৯৫৭৫৪), নন-এসি ঘরের ভাড়া ১,২০০ টাকা, এসি ঘরের ভাড়া ১,৬০০ টাকা, ১,৮০০ টাকা এবং ৩,০০০ টাকা।
  • হোটেল পিনাকী সদন (৯৪৩৪৮-৫৪৮৪৫), দ্বিশয্যা ঘরের ভাড়া ৮৫০-৯৫০ টাকা এবং তিনশয্যা ঘরের ভাড়া ১,২০০ টাকা।

উপসংহার :

পুরুলিয়ার টুসু উৎসব ও শিলাবতী পরব একটি অনন্য লোকউৎসব। এই উৎসব শুধু স্থানীয় মানুষের কাছে নয়, পর্যটকদের কাছেও একটি বিশেষ আকর্ষণ। আপনিও যদি এই সময় পুরুলিয়া ভ্রমণ করেন, তাহলে এই উৎসবের আনন্দ থেকে বঞ্চিত হবেন না।

✨ জীবনে একবার এই মেলা দেখতে অবশ্যই যান।
বন্ধুদের সাথে শেয়ার করুন এবং আপনার পরিকল্পনা করুন! 😊
📸 আপনার মতামত ও অভিজ্ঞতা শেয়ার করুন!
আপনি কখন শিলাই পরব দেখতে গিয়েছিলেন? মন্তব্যে জানাতে ভুলবেন না। ❤️

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

0মন্তব্যসমূহ

We welcome thoughtful discussions. Comments are moderated for quality

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন (0)

#buttons=(Ok, Go it!) #days=(20)

Our website uses cookies to enhance your experience. Check Now
Ok, Go it!