👻 শিশুরক্ষক নাকি শিশুমারক? বাংলার লৌকিক দেবতা 'পাঁচুঠাকুর' ও পাঁচিঠাকুরানির আদ্যোপান্ত ।

শিশুরক্ষক পাঁচুঠাকুর (পেঁচোঠাকুর): ভয়াল রূপ, পাঁচিঠাকুরানির পূজা ও মানতের প্রথা

বাংলার অজস্র পল্লী অঞ্চলে আজও বহু বিচিত্র এবং ভয়াল আকৃতির লৌকিক দেবতার পূজা প্রচলিত। এঁদের মধ্যে অন্যতম হলেন পাঁচুঠাকুর, যিনি 'পেঁচোঠাকুর' নামেও অধিক পরিচিত। পল্লীবাসীদের কাছে ইনি একদিকে যেমন শিশুরক্ষক, তেমনই অন্যদিকে মারক বা অতি ক্রুদ্ধ স্বভাবের দেবতা হিসেবে গণ্য হন। তাঁর বীভৎস, আদিম ভাবাপন্ন রূপ এবং আরাধনার বিশেষ রীতিনীতি তাঁকে বাংলার লোক-ধর্মবিশ্বাসে এক স্বতন্ত্র স্থান দিয়েছে।

এই পোস্টে পাঁচুঠাকুরের ভয়াল রূপ, পাঁচিঠাকুরানির সহাবস্থান, আরাধনার বিশেষ নিয়মাবলী এবং পঞ্চানন্দের সঙ্গে তাঁর পার্থক্য নিয়ে বিস্তারিত আলোচনা করা হলো। 

১. মূর্তির বর্ণনা: আদিমতা ও বীভৎসতার প্রতীক

পাঁচুঠাকুরের মূর্তি আদিম যুগের দেবকল্পনা ও মূর্তিগঠনের একটি অক্ষুণ্ণ নিদর্শন। তাঁর রূপ অতিশয় ভয়াবহ ও বীভৎস।

রং ও কেশ: তাঁর রং কালো। মাথায় জটা বা চুল ঝুঁটি করে বাঁধা থাকে।

বিশেষ বৈশিষ্ট্য: চোখ দুটি বেশ বড়, প্রায় গোলাকার এবং কিছুটা লালচে। কপালে তিলক ও পুরু ঠোঁটও একই লাল রংয়ের। দাঁতগুলি বের করা অবস্থায় থাকে।

পোশাক ও সজ্জা: তিনি ছোট একখণ্ড হলুদ রঙের কাপড় পরেন। কানে, গলায় ও হাতে নানা ধরনের গহনা থাকে। দেহের বহু স্থানে শাদা বা লাল রঙের ফোঁটা লাগানো থাকে।

শিঙ: কিছু বিরল থানে তাঁর মাথায় দুটি শিঙও দেখা যায়।

পাঁচি-ঠাকুরানি: শক্তি ও সহচরী

পাঁচুঠাকুর প্রায় সব সময় তাঁর স্ত্রী বা শক্তির সঙ্গে থাকেন, যাঁকে 'পাঁচি-ঠাকুরানি' বলা হয় এবং তিনি স্বামীর সঙ্গে পূজিত হন।

রূপ: পাঁচিঠাকুরানির আকৃতি স্বামীর মতো ভয়াবহ নয়, বরং কিছুটা সৌম্য।

সজ্জা: তাঁর রং হলুদ, সিঁথিতে সিঁদুর এবং গা ভরা গহনা থাকে। পরনে থাকে হাঁটু পর্যন্ত চওড়া লাল পাড়ের শাড়ি।

মুখাবয়ব: তাঁর চোখ গোলাকার না হলেও, বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই দাঁতগুলি বের করা অবস্থায় দেখা যায়।

২. কেন পাঁচুঠাকুরের পূজা করা হয়? (মানত ও উদ্দেশ্য)

পাঁচুঠাকুর প্রধানত শিশু-সংক্রান্ত সমস্যার সমাধানকারী দেবতা। যে নারীরা মৃত সন্তান প্রসব করেন, যাঁদের সন্তান শৈশবেই মারা যায়, অথবা যাঁদের সন্তান রিকেটস্ ('পেঁচোয়-ধরা' বা 'পুঁয়ে-পাওয়া') বা ধনুষ্টঙ্কার রোগে ভোগে—তাঁরাই এই দেবতার শরণাপন্ন হন।

মানতের কারণ: সন্তান রোগমুক্ত হলে বা গর্ভস্থ ভ্রূণ রক্ষা পেলে পাঁচুঠাকুর ও পাঁচিঠাকুরানিকে আড়ম্বরের সঙ্গে পূজা দেওয়ার জন্য মানত বা মনস্কামনা করা হয়।

মানতের চিহ্ন: এরূপ প্রতিজ্ঞার চিহ্নস্বরূপ দেবতার থানে দড়ি দিয়ে ঢেলা ঝুলিয়ে রাখা হয়। বিশ্বাস করা হয়, ঢেলাটি দেবতার দৃষ্টিগোচর হলে তিনি শিশু বা ভ্রূণকে রক্ষা করবেন।

৩. রোগমুক্তির বিশেষ আচার: 'দোরধরা' প্রথা

যে রুগ্ন সন্তানের অভিভাবকেরা সন্তানের রোগমুক্তির জন্য দেবতার শরণাপন্ন হন, তাঁরা ১১ বছর পর্যন্ত বিশেষ আচার পালন করেন। 

আচারের নিয়মাবলী	তাৎপর্য
রক্ষাকবচ	জন্মাবধি সন্তানের চুল কাটা হয় না।
ডাড়কো পরিধান	সন্তানের পায়ে পাঁচুদেবতার রক্ষাকবচরূপে লোহার বালা, যাকে স্থানীয় ভাষায় 'ডাড়কো' বলা হয়, তা পরানো থাকে।
চিকিৎসা	ডাক্তার বা কবিরাজ দিয়ে তার চিকিৎসা করানো হয় না।

 চুল কামানো ও মানত পূজার দিন:

রোগমুক্তির পর বা ১১ বছর বয়স পূর্ণ হলে অভিভাবকরা বাদ্য-বাজনা সহকারে (ঢোল, কাঁশি, সানাই) সন্তানকে দোলা বা পাল্কীতে করে থানে নিয়ে যান।

প্রথম ক্ষৌরকর্ম: এই দিন সন্তানটির প্রথম চুল কামানো হয়।

দণ্ডী পরিক্রমা: সন্তানের মা বা বড় বোন থানের কাছাকাছি পুকুরে স্নান করে ভিজে কাপড়ে তিনবার বা সাতবার দণ্ডী কেটে দেবতার থান পরিক্রমা করেন।

পূজা ও ধূনি: সন্তানের মা বা বোন নিজের মাথায় জ্বলন্ত বা ধূমায়িত ধূনি স্থাপন করে দেবতার দরজার পাশে হাতজোড় করে বসে থাকেন।

বলি ও ভোগ: ছাগ বলি দেওয়া হয় এবং আমিষ-নিরামিষ দুই প্রকার নৈবেদ্যই দেওয়া হয়।

'ডাড়কো' খোলা: পূজার শেষে পুরুত নিজে সন্তানটির পায়ের 'ডাড়কো' খুলে দেন।

নামকরণ: পাঁচুঠাকুরের কৃপাপ্রাপ্ত পুত্রসন্তানের নাম 'পাঁচু' যুক্ত হয় (যেমন পাঁচুগোপাল, পাঁচুচরণ)। এই সন্তানকে 'পাঁচুঠাকুরের দোরধরা' ছেলে বলা হয়।

৪. পূজারী ও দিনক্ষণ

পূজারী: কোনো বর্ণ-ব্রাহ্মণ পাঁচুঠাকুরের পূজা করেন না। অধিকাংশ থানে গ্রাম্য মোড়ল বা প্রধান এবং

 পূজার বিধান: পূজায় বিশেষ কোনো মন্ত্র নেই। তবে কোনো উন্নত পল্লীতে শিবের অনুচর বা পুত্র কল্পনা করে শিবের আরাধনার মাধ্যমে পূজা শুরু করা হয়।

শুভ দিন: শনি ও মঙ্গলবার এই দেবতার পূজার জন্য প্রশস্ত দিন।

৫. পাঁচুঠাকুর ও পঞ্চানন: পার্থক্য কোথায়?

অনেক সময় পঞ্চানন্দ বা পঞ্চানন নামক আরেক প্রসিদ্ধ লৌকিক দেবতাকে ভুলবশত 'পাঁচুঠাকুর' বলা হয়। কিন্তু তাঁরা ভিন্ন দেবতা: 

বৈশিষ্ট্য	পাঁচুঠাকুর (আলোচ্য দেবতা)	পঞ্চানন্দ বা পঞ্চানন
রং	কালো	রক্তবর্ণ (ধ্যান মন্ত্রে: 'রক্তবর্ণং দিগম্বরং')
আকৃতি	বলিষ্ঠ আকৃতি	ভিন্ন (কঙ্কালসার নয়)
প্রকৃতি	শিশুরক্ষক ও শিশুমারক	শিশুরক্ষক, কিন্তু শিশুমারক নন
পূজা স্থান	বাসস্থান থেকে দূরে বট বা অশ্বত্থ গাছের তলায় মাটির ঘর	ভিন্ন পূজা বাসের ক্ষেত্র
সহচর	স্ত্রী পাঁচি-ঠাকুরানি সর্বদা পূজিত হন	'পেঁচো-খেঁচো' বা 'ধনু-টঙ্কার' নামে একজোড়া কঙ্কালসার মূর্তি সহচর রূপে থাকে, কিন্তু তারা স্বাধীন দেবতা নয়

৬. পাঁচুঠাকুরের স্থান ও পূজা ব্যবস্থাপনা

থান: পাঁচুঠাকুর কারুর ব্যক্তিগত বা গৃহদেবতারূপে পূজা পান না। বাসস্থান থেকে কিছু দূরে কোনো জলাশয়ের তীরে বড় বট বা অশ্বত্থ গাছের তলায় ।

 

পূজার প্রকার: এখানে সাপ্তাহিক ও বার্ষিক ('জাতের') পূজা হয়।

 

খরচ সংগ্রহ: 'জাতের' বা বার্ষিক পূজার জন্য গ্রাম্য মোড়ল ও ভক্তরা পল্লীর সকল বাড়িতে গিয়ে মাঙন (ভিক্ষা) করে অর্থ ও ফলমূল সংগ্রহ করেন। পল্লীবাসীরা 'মুদ্রা বাঁধা পয়সা' (শিশুর কল্যাণে সারা বছর সঞ্চয় করা অর্থ) এই পূজার জন্য দান করেন।

বিশেষ স্ত্রী-আচার: 'পাঁচুটে' (পঞ্চবৃত্ত)

২৪ পরগণা ও আরও দু-একটি জেলায় রুগ্ন শিশুর রোগমুক্তির উদ্দেশ্যে পাঁচুঠাকুরের পূজা হলেও, এই প্রদেশের প্রায় সর্বত্রই তাঁর পূজা একটি স্ত্রী আচার হিসেবে পালিত হয়। সন্তান ভূমিষ্ঠ হওয়ার পঞ্চম দিনে আঁতুড় ঘরে যে 'পাঁচুটে' (শুদ্ধ কথায় পঞ্চবৃত্ত) নামে স্ত্রী-আচার পালন করা হয়, তা এই দেবতার সঙ্গেই সম্পর্কিত।

---

উপসংহার: পাঁচুঠাকুর বাংলার লোকসংস্কৃতিতে ভয় এবং ভক্তির এক চমৎকার মিশ্রণ। তাঁর আদিম রূপ এবং মানত পূজার জটিল রীতিনীতি আজও এই অঞ্চলের ধর্মবিশ্বাসের গভীরতা প্রমাণ করে।