📿 উলাইচণ্ডী মেলা, বিরনগর: নদিয়ার এক বিস্মৃত জাগ্রত দেবীর উৎসব

উলাইচণ্ডী মেলা

✍️:Raju Biswas

বীরনগর,নদীয়া:মা উলাইচণ্ডীকে ঘিরে রয়েছে একাধিক কিংবদন্তি। হিন্দু ধর্মের বিভিন্ন মঙ্গলকাব্যেও পাওয়া যায় সেই কথা। এই বঙ্গের জাগ্রত জননীরূপে তিনি পরিচিত, এবং অলৌকিক শক্তির ধারক হিসেবেও ভক্তদের মনে বিশ্বাস অর্জন করিয়েছেন। বিরনগরসহ পার্শ্ববর্তী এলাকা থেকে শুরু করে, এমনকি জেলা, রাজ্য ও দেশ-বিদেশের নানা প্রান্তে ছড়িয়ে পড়েছে দেবীর মহিমার কথা। বুদ্ধমূর্নিমা লগ্নে এই দেবীর পূজা অনুষ্ঠিত হয়।

পূজো কমিটির সদস্যরা জানিয়েছেন, গত বছরগুলোতে বাংলাদেশ থেকে অনেক ভক্ত মনোস্কামনা পূরণের আশায় পুজো দিতে আসতেন। কিন্তু এবার রাজনৈতিক উত্তেজনার কারণে ভক্তরা সময়মতো উপস্থিত হতে পারেননি, হয়তো এই বছর। কিংবদন্তি ও লোকবিশ্বাসের অনবদ্য সংমিশ্রণে দাঁড়িয়ে আছে উলাইচণ্ডী মেলা।

কিংবদন্তি ও লোকবিশ্বাসের অনবদ্য সংমিশ্রণে দাঁড়িয়ে আছে উলাইচণ্ডী মেলা — এক রাজবংশীয় বৃত্তান্ত, যা আজও বাংলার গ্রামীণ সংস্কৃতির এক অমূল্য অংশ। চলুন, ফিরে দেখা যাক এই মেলার উৎস, জনশ্রুতি এবং বর্তমান বাস্তবতা।

উলাইচণ্ডী মায়ের ইতিহাস ও নামকরণের জনশ্রুতি

উলাইচণ্ডী নামটি আদতে এসেছে  “উলা”  শব্দ থেকে। স্থানীয়রা বিশ্বাস করেন, উলাইচণ্ডী হলেন দেবী কালী বা চণ্ডীর এক জাগ্রত রূপ। এখানে কোনো  বিগ্রহ নেই, তবে একটি শিলার খণ্ড রয়েছে। জঙ্গলের মাঝে, একটি থান শ্বেতপাথর দিয়ে বাঁধানো , উপরে  লোহার দণ্ডে একাধিক ঘন্টার বাধা।  তার নিচে মাঝবরাবর  পূজিত শিলা আছে।একদম পাখির কূজন ও শান্ত পরিবেশের মাঝে প্রকৃতির কোলে উলা দেবীর বাস।

Read more:

লোড হচ্ছে...

উলাইচণ্ডী দেবীর বয়স ও উৎস

উলাইচণ্ডী দেবীর সঠিক বয়স নির্ধারণ করা সম্ভব নয়। তবে লোকমুখে প্রচলিত কিছু ইতিহাস ও কিংবদন্তি রয়েছে । 
অনেক ঐতিহাসিকের মতে, এই দেবী আসলে হাড়ি সম্প্রদায়ের পূজিত এক শিলার খণ্ড, যেখানে প্রাচীনকালে শুকর বলি দিয়ে পূজা করা হতো। কালের প্রবাহে সেই আরাধনাই রূপ নিয়েছে ব্রাহ্মণ মন্ত্রে হিন্দু ধর্মের চণ্ডী মাতা, অর্থাৎ উলাইচণ্ডী দেবী হিসেবে।

এই সমস্ত ইতিহাসের ভিত্তিতে অনুমান করা হয়, উলাইচণ্ডী পূজার বয়স প্রায় ৪০০ থেকে ৫০০ বছর হতে পারে। আজও এই শিলার খণ্ডটি প্রকৃতির মাঝে, খোলা আকাশের নিচে পূজিত হয় — যা এক ধরনের আদিম মাতৃ আরাধনার নিদর্শন।

নৃবিজ্ঞান ও লোকবিশ্বাসের ভিত্তিতে দেবীর উৎস

নৃবিজ্ঞানীদের মতে, দেবী আরাধনার বিবর্তনের প্রাথমিক ধাপে দেবীকে পূজা করা হতো জুমরফিক (Zoomorphic) রূপে — অর্থাৎ পাহাড়-পর্বত, শিলা খণ্ড, পশু বা পাখির প্রতীক হিসেবে। এই ধাপেই প্রকৃতির শক্তিকে দেবী রূপে আরাধনা করার প্রথা গড়ে ওঠে।

Read more:

লোড হচ্ছে...

আবার অনেকের বিশ্বাস, চাঁদ সদাগরের স্বপ্নাদেশে পূজিত সেই শিলা খণ্ড একদা একটি ডাকাত দল চুরি করে নিয়ে যায়। পরবর্তীতে স্থানীয় কেউ স্বপ্নাদেশ পেয়ে সেই শিলা খণ্ডটিকেই এই স্থানে প্রতিষ্ঠা করেন — যা আজ উলাইচণ্ডী দেবী হিসেবে পূজিত হয়ে আসছে।

 🧬 মুস্তৌফী পরিবার ও পূজার রীতিনীতি

উলাইচণ্ডী মন্দিরের পূজা এবং মেলার প্রবর্তন করেন মুস্তৌফী বংশের পূর্বপুরুষরা। এই পরিবার ছিল তৎকালীন রাজস্ব সংগ্রাহক (Mustaufi)। বংশীয় নিয়মে তাঁরা প্রতিবছর বৈশাখী পূর্ণিমায় এই মেলার আয়োজন করতেন।

 🌸 পূজার বিশেষত্ব 🌸

 সন্ধ্যায় অনুষ্ঠিত হয় চণ্ডীপাঠ ও অগ্নিযজ্ঞ — ভক্তদের অংশগ্রহণে পরিবেশ ভরে ওঠে দেবীময় আবহে।
 পূজার দিন অনুষ্ঠিত হয় বাউল, কবিগান ও পালা — মেলায় যেন ছড়িয়ে পড়ে লোকসংস্কৃতির রঙিন আবহ।
🐐 কয়েক দশক আগেও এই পূজায় ১০০-র বেশি পশুবলি দেওয়া হতো, যা ধর্মীয় রীতিনীতির অংশ। তবে সময়ের পরিবর্তনে এখন সেই সংখ্যা অনেকটাই কমেছে — বর্তমানে প্রায় ১০-১২টির মতো বলি দেওয়া হয়।যদিও এই প্রথা পুরোপুরি বন্ধ হয়নি, তবুও সমাজ ধীরে ধীরে মানবিক চেতনার দিকে অগ্রসর হচ্ছে।

🎉 বৈশাখী বুদ্ধ পূর্ণিমা ও মেলার তাৎপর্য 🎉

🌕 বৈশাখী বুদ্ধ পূর্ণিমার দিন উলাইচণ্ডী মন্দির চত্বর পরিণত হয় এক উৎসবমুখর আনন্দমেলায়।
🎨 বসে হস্তশিল্প, খেলনা, মিষ্টি ও নাগরদোলার বাহারি পসরা — ছোট-বড় সকলের মন কাড়ে এই মেলার বৈচিত্র্য।
🚶‍♂️🚶‍♀️ দূরদূরান্ত থেকে মানুষ ছুটে আসে জাগ্রত দেবীর আশীর্বাদ নিতে, হৃদয়ে ভরে থাকে এক অনন্য ভক্তিভাব।

⏳ আগে যেখানে তিনদিনব্যাপী অনুষ্ঠান হতো, এখন তা শুধুমাত্র পূর্ণিমার একদিনেই সীমাবদ্ধ।
❤️ তবে উৎসাহ, ভক্তি ও আবেগ—এই তিনটি শক্তিই আজও অটুট রয়েছে ভক্তদের হৃদয়ে।

  মেলার ইতিহাস: এক সময়ের জমজমাট উৎসব

একসময় এই মেলাই ছিল বিরনগরের বারো মাসে তেরো পার্বণের অন্যতম প্রধান আকর্ষণ। মুস্তৌফী পরিবারে যাঁদের হাত ধরে এই মেলার গোড়াপত্তন, তাঁরা একসময় বড়লোক জমিদার ও শিক্ষিত মানুষ ছিলেন। স্থানীয় স্কুল, ক্লাব ও নানা সমাজকল্যাণমূলক কর্মকাণ্ডেও তাঁদের অবদান ছিল প্রশংসনীয়।

বিরনগরের সংস্কৃতি ও উলাইচণ্ডী মেলার ভূমিকা

উলাইচণ্ডী মেলা শুধুই একটি পূজা নয়, এটি এক সামাজিক ও সাংস্কৃতিক মিলনক্ষেত্র। এখানকার অনেক মানুষ এই মেলাকে ঘিরেই পারিবারিক পুনর্মিলন ঘটান। শিশুরা পায় খেলনার দোকান, তরুণরা পায় সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানে অংশ নেওয়ার সুযোগ, এবং প্রবীণরা খুঁজে পান পুরনো দিনের স্মৃতির ছোঁয়া।

 

Read more:

লোড হচ্ছে...

আধুনিক সময়ে মেলার সংকট ও ভবিষ্যৎ ভাবনা

দুঃখজনক হলেও সত্য, সময়ের সাথে সাথে এই ঐতিহ্যবাহী মেলা হারিয়েছে তার আগের জৌলুস। মুস্তৌফী পরিবারের অনেক সদস্য এখন ভিন্ন পেশায় ব্যস্ত, বা শহরে বসবাস করছেন। মেলার আয়োজন এখন অনেকটাই প্রতীকী। স্থানীয় প্রশাসন বা পঞ্চায়েতের পক্ষ থেকে বড় কোনো উদ্যোগ নেই। তবে যদি সচেতন নাগরিক ও স্থানীয় উদ্যোগ নিয়ে এগিয়ে আসে, তবে এই ঐতিহ্য আবারো ফিরে পেতে পারে তার প্রাচীন মহিমা।

📍 কীভাবে যাবেন উলাইচণ্ডী মেলায়?

লোকেশন: বিরনগর, নদিয়া, পশ্চিমবঙ্গ
নিকটতম স্টেশন: বিরনগর স্টেশন, স্টেশন থেকে ১০ টাকা টোটো ভাড়া। ৩ থেকে ৫ মিনিটের রাস্তা টোটো তে।
কখন হয়?- বৈশাখী বুদ্ধ পূর্ণিমা লগ্নে।

🚗 সড়ক পথে: রানাঘাট থেকে ২৫ মিনিট।🛺 স্থানীয় টোটো বা রিজার্ভ অটো সহজলভ্য 🚙 

  💰উলাইচণ্ডী মেলা: স্থানীয় অর্থনীতি ও উন্নয়ন সম্ভাবনা

একটি মেলা স্থানীয় মানুষের অর্থনীতির বিকাশ ঘটায়, সেটি ঠিক। এই মেলায় খুবই ভিড় হয় পুজো দেওয়ার জন্য এবং এখানে জলছত্রের ব্যবস্থা রয়েছে, যা মানুষের সুবিধা হয়। তবে, আমার অভিজ্ঞতা অনুযায়ী, আরও কিছু উন্নতি প্রয়োজন।

🚨 মেলা চত্বরে পুলিশ প্রশাসন রয়েছে, যা নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে সহায়ক। তবে, চুরি ও পকেটমারের হাত থেকে সুরক্ষিত রাখতে পুরো মেলা চত্বরে সিসিটিভি ক্যামেরা বসানো। কিন্তু ক্যামেরার গুণমান কিছুটা প্রশ্নবিদ্ধ বলে মনে হলো।

💡 রাজ্য সরকারের সহযোগিতায় মেলাকে ঘিরে স্থানীয় ট্যুরিজমের বিশাল সম্ভাবনা রয়েছে। সবার আগে, মেলা উপলক্ষে যাতায়াতের জন্য গাড়ির ব্যবস্থা করা প্রয়োজন। 🚗

🚉 রানাঘাট-কৃষ্ণনগর রেইন লাইন দিয়ে যাতায়াত সুবিধা রয়েছে, তবে সড়ক পথে গাড়ি খুবই কম। 

🏙️ 🔑 বিরনগর পৌরসভার ১ নম্বর ওয়ার্ডে এই মেলা চত্বরে।

 🎡 কেন আপনার এই মেলাতে আসা উচিত?

✅ একদিনের মধ্যে ঘুরে আসার উপযুক্ত স্পিরিচুয়াল গন্তব্য — ছুটির দিনে পরিবার বা বন্ধুদের সঙ্গে একটু শান্তিপূর্ণ পরিবেশে আত্মিক প্রশান্তি খুঁজছেন? উলা চন্ডী মেলা তার আদর্শ ঠিকানা।

✅ বুদ্ধপূর্ণিমা ছাড়া অধিকাংশ সময় ভিড় নেই  — তাই নিরিবিলি পরিবেশে ঠাকুর দর্শন ও প্রাকৃতিক সৌন্দর্য উপভোগ করতে পারবেন। চারপাশে ছায়াঘন বৃক্ষ আর গ্রামের শান্ত পরিবেশ মনকে ঠান্ডা করে।

✅ লোকাল ইতিহাস ও সংস্কৃতির সঙ্গে পরিচিত হওয়ার দুর্দান্ত সুযোগ — চন্ডীমাতা এখানে 'ঘোড়া বেঁধে মানস' গ্রহণ করেন, এই বিশ্বাস বহু প্রজন্ম ধরে গ্রামীণ জনজীবনের সঙ্গে ওতপ্রোতভাবে জড়িত। এমন প্রাচীন লোককথা ও আচার জানলে আপনার ভ্রমণ আরও অর্থবহ হয়ে উঠবে।
কয়েকদশক
👉 একদিনের ছুটি? তাহলে ব্যাগ গুছিয়ে এই পবিত্র মেলাতে ঘুরে আসুন। আত্মিক শান্তি, ইতিহাস, ও প্রকৃতির এক অপূর্ব মিশ্রণ—সব একসাথে পাবেন এখানে।

উপসংহার

উলাইচণ্ডী মেলা শুধুই একটি ধর্মীয় অনুষ্ঠান নয় – এটি এক ইতিহাস, এক জীবনধারা, এক সংস্কৃতি। বাংলার গ্রামগঞ্জে ছড়িয়ে থাকা হাজারো এমন মেলা আমাদের শিকড়ের কথা বলে, মনে করিয়ে দেয়, আমাদের ঐতিহ্য এখনও হারায়নি – শুধু খুঁজে দেখার অপেক্ষা।

🔍 প্রায়শই জিজ্ঞাসিত প্রশ্নাবলি (FAQs) – উলাইচণ্ডী মেলা

উলাইচণ্ডী মেলা কোথায় হয়?

উলাইচণ্ডী মেলা হয় পশ্চিমবঙ্গের নদিয়া জেলার বিরনগর শহরে। এটি রানাঘাট ও শ্রীনগর রেলস্টেশনের কাছাকাছি অবস্থিত।

উলাইচণ্ডী মেলার তারিখ কবে ২০২৫-এ?

২০২৫ সালে উলাইচণ্ডী মেলা অনুষ্ঠিত হবে বৈশাখী পূর্ণিমায়। সুনির্দিষ্ট তারিখ চাঁদের অবস্থানের উপর নির্ভর করে নির্ধারিত হয়।

উলাইচণ্ডী মন্দির কীভাবে যাবেন?

আপনি রানাঘাট বা শ্রীনগর স্টেশনে নেমে স্থানীয় টোটো বা রিকশা ধরে সহজেই মেলায় পৌঁছাতে পারেন।

উলাইচণ্ডী মেলায় কী দেখা যায়?

মেলায় থাকে হস্তশিল্পের দোকান, খেলনা, প্রসাদ বিতরণ, ভক্তিমূলক গান ও সন্ধ্যায় যজ্ঞ। এটি একটি ধর্মীয় ও সাংস্কৃতিক মিলনস্থল।

উলাইচণ্ডী মেলার গুরুত্ব কী?

উলাইচণ্ডী দেবীকে জাগ্রত দেবী মনে করা হয়। মুস্তৌফী পরিবারের উদ্যোগে এই পূজা শুরু হয়েছিল এবং এটি আজও গ্রামীণ ভক্তদের কাছে এক বিশাল ধর্মীয় উৎসব হিসেবে পরিচিত।